আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন পদ্মা সেতু আর পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে দ্বিতীয় সিঙ্গাপুরের মতো সক্ষম হচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি। এছাড়া দেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র হতে যাচ্ছে বরিশালের হিজলা উপজেলার হিজলা-গৌরবদী ইউনিয়নের মেঘের চর নামক এলাকায়। ফলে দক্ষিণাঞ্চল হতে যাচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় ‘সিঙ্গাপুর’ শহর।
প্রধানমন্ত্রীর পায়রা এলাকায় অবস্থিত বিদ্যুতকেন্দ্র ও তৎসংলগ্ন বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করার কথা রয়েছে। এর পূর্ব প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বরিশালের রেঞ্জ ডিআইজি শফিকুল ইসলাম পায়রা এলাকায় থার্মাল প্লান্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্টদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চল এখন আর অবহেলিত নেই। সরকারপ্রধানসহ একাধিক মন্ত্রী, এমপি, নেতাসহ সরকারের অনেক কর্মকর্তার মুখে ঘুরেফিরেই উচ্চারিত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের ‘সিঙ্গাপুর’ বনে যাওয়ার গল্প।
সঙ্গে রয়েছে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করার বিরল সুযোগের পর্যটন কেন্দ্র সাগরকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। পদ্মা সেতুর কল্যাণে রেললাইন আসছে পায়রা পর্যন্ত। এক হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ভূমি উন্নয়ন প্রকল্প ১১ অক্টোবর একনেকের সভায় অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পায়রা এলাকায় নির্মিত হয়েছে বিদ্যুতকেন্দ্র। দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে বিস্তৃত নৌপথ, বরিশালে আইসিটি পার্ক, অর্থনৈতিক জোন, বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, বরিশালের আগৈলঝাড়া ও ভোলায় বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, ভোলা-বরিশাল ব্রিজ, ভোলার গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে বরিশালে আনার উদ্যোগসহ বর্তমান সরকারের টানা দুবারের মেয়াদে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়নে এখানে ব্যাপক হারে গড়ে উঠবে দেশী-বিদেশী শিল্প-কলকারখানা। পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হবে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। হবে ব্যবসায়িক জোন। এমন ভাবনায় আগে থেকেই দক্ষিণাঞ্চলমুখী হয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। নতুন করে অনেকে আসছেন স্বপ্নের ‘সিঙ্গাপুরের’ উদ্যোক্তা হতে। কেউ পছন্দের জমি পাচ্ছেন, কেউ এখনও খুঁজছেন। তবে আশা ছাড়ছেন না। কীভাবে গড়ে উঠবে স্বপ্নের ‘সিঙ্গাপুর’, কবে হবে দৃশ্যমান।
বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের পরিচালক মোঃ আতিকুর রহমান বলেন, সিঙ্গাপুর একদিনে এমন হয়নি। এক সময় মালয়েশিয়া তাদের বের করে দিয়েছে। তাদের নেতা লি কুয়ানের অদম্য প্রচেষ্টায় সিঙ্গাপুর আজ এ অবস্থায়।
মাত্র ৭৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সিঙ্গাপুর এখন সারা বিশ্বে উজ্জ্বল। তিনি আরও বলেন, পায়রা বন্দর, পদ্মা সেতু হচ্ছে, লেবুখালীতে হচ্ছে সেতু এবং সেনানিবাস, কলাপাড়ায় বিদ্যুত কেন্দ্র হচ্ছে, ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা-পায়রা ফোর লেন ও রেললাইন প্রক্রিয়াধীন। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পায়রা বন্দর হবে অন্যতম। এখানে জমির মূল্য কম। রয়েছে সস্তা শ্রম। পদ্মা সেতুর কানেকশন হয়ে গেলেই শুরু হবে ইন্ডাস্ট্রিজ।
আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, এখনও দক্ষিণের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। কৃষি-অর্থনীতির উন্নয়নে কৃষির বৈচিত্র্যকরণ, আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির প্রয়োগ, নদীভাঙ্গন রোধ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, লবণপানির প্রভাব মোকাবেলা, স্বল্পসুদে কৃষিঋণ এবং বাজারজাতকরণের জন্য প্রচুর অবকাঠামো নির্মাণ জরুরী। কৃষি ছাড়াও দক্ষিণে এখন শিল্পায়নের বিশাল সম্ভাবনা সৃষ্টির কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, পূর্বে ভোলার গ্যাস, পশ্চিমে মংলাবন্দর, উত্তরে পদ্মা সেতু আর দক্ষিণে পায়রা বন্দর ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত এই পাঁচের সম্মিলনে মাত্র কয়েক বছরেই জেগে উঠছে দক্ষিণাঞ্চল। দক্ষিণে সস্তা শ্রম, অব্যবহৃত জমি, কম খরচে নৌপরিবহনসহ সড়কপথেও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ব্যাপক শিল্পের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে অপসোনিনসহ অনেকেই শিল্প সম্প্রসারণ করেছে। উদ্যোগী হয়েছেন অনেকে।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস এমপি সিঙ্গাপুর বনে যাওয়া সম্পর্কে বলেন, দ্রুতগতিতে চলছে পায়রা বন্দর ও পদ্মা সেতুর কাজ। ফোর লেন অনুমোদন দিয়েছে সরকার। পায়রা-কুয়াকাটা পর্যন্ত লেবুখালীর সেতু শেষ পর্যায়ে থাকলেও অন্যসব সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। নৌযোগাযোগের উত্তম ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী ভোলার গ্যাস বরিশালে আনার ঘোষণা দিয়েছেন, কলাপাড়ায় হচ্ছে বিদ্যুত কেন্দ্র,লেবুখালীতে হয়েছে সেনানিবাস।
পদ্মার এপার হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বরিশালের হিজলা উপজেলায় হবে দেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র্র। কুয়াকাটা ও বরিশালে সরকারী উদ্যোগে হচ্ছে দুটি ফাইভস্টার হোটেল। চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বরিশালে ব্যাপক হারে গড়ে উঠবে শিল্প-কলকারখানা। কর্মসংস্থান হবে লাখ লাখ মানুষের। সবকিছু মিলিয়ে শিল্প, ব্যবসা আর পর্যটনের ওপর ভিত্তি করে ‘সিঙ্গাপুরে’ পরিণত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল এমনটাই মনে করছেন তালুকদার মোঃ ইউনুস এমপিসহ বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা ও জনপ্রতিনিধিরা।
শুধু শিল্প আর ব্যবসা-বাণিজ্যেই নয়, পায়রার অদূরেই রয়েছে ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। যেখানে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় সূর্যান্ত ও সূর্যোদয়। রয়েছে দেশের বৃহত্তম প্রাচীন বৌদ্ধমন্দির, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় উপভোগ করা যায় পৃথিবীর মাত্র দুটি স্থানে। এর একটি হলো কুয়াকাটা আর অন্যটি জাপান। কুয়াকাটা থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত সাইট ট্যুরও এখন সময়ের ব্যাপার। কুয়াকাটা মাস্টার প্ল্যানে রয়েছে জাতীয় ক্রিকেট ভেন্যু, দুটি স্টল এয়ারপোর্ট, মেরিন ড্রাইভ ইত্যাদি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উৎসাহে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে দীর্ঘদিন থেকে নিজেকে আত্মনিয়োগ করে ‘উন্নয়নের রূপকার’ খেতাব অর্জন করা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মন্ত্রী ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি দক্ষিণাঞ্চলের বদলে যাওয়ার রহস্য সম্পর্কে বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতবার ক্ষমতায় এসেছেন ততবারই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। খুলনা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে দুটি বন্দরে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে। অর্থনীতিতে ওই দুই অঞ্চল অনেক সমৃদ্ধ। এই দুই বিভাগের মাঝে বরিশালের ছয় জেলার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, বাগেরহাট দীর্ঘদিন পিছিয়ে ছিল।
এ অঞ্চলের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর, মহাসড়ক ফোরলেন, রেললাইন, লেবুখালীতে সেতু ও সেনানিবাস, কলাপাড়ায় তাপবিদ্যুত কেন্দ্র, হিজলায় পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র এবং পদ্মার এপারে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মানসহ আগৈলঝাড়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজও এগিয়ে চলছে।
ইতোমধ্যে তিনশ’ একর জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। পিছিয়েপড়া দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে এত মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েই প্রধানমন্ত্রী তার দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এটাই বদলে যাওয়ার মূল রহস্য বলে মনে করেন দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগের অভিভাবকখ্যাত আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনরায় নির্বাচিত করার আহবান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আগামী কয়েক বছরে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছলে দ্বিতীয় সিঙ্গাপুরের চেহারায় ফুটে উঠবে গোটা দক্ষিণাঞ্চল।
এক অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১০ সালে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১.৫ শতাংশ। অথচ ওই বছর বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৯.৪ শতাংশ। ২০১৬ সালে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৪ ভাগ এবং বরিশালের দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬.৫ ভাগ। অর্থাৎ পিছিয়ে থাকলেও বরিশালে দ্রুত কমছে দারিদ্র্যের হার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বরিশালে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র বেড়ে যাওয়ায় দ্রুত কমতে শুরু করেছে দারিদ্র্যের হার। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বরিশাল বিভাগের দারিদ্র্যের হার ১৫ থেকে ১৬ শতাংশে নেমে আসবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পাশে ২৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত হবে আইসিটি পার্ক। সড়ক ও জনপথ বিভাগের পাঁচ একর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে পার্ক নির্মাণের জন্য। এখানে গড়ে উঠবে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। যারা শুধু দেশীয় নয়, বিদেশী কোম্পানির কাজও সম্পাদন করবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এখানে ২৩ হাজার বেকার যুবক-যুবতী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। এছাড়া বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার পয়সারহাট এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজও এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে তিন শ’ একর জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে এখানকার অর্থনৈতিক জোন বরিশালের অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাবে। মানুষের চাহিদা অনুযায়ী এখানে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা হবে। উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বরিশাল সদর উপজেলার চর আইচায় ১০একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তুতি চলছে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার স্থাপনের জন্য। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে পর্যটন কর্পোরেশন।
অপরদিকে দেশের সর্ববৃহৎ দ্বীপজেলা ভোলায় আরেকটি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সদর উপজেলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নে ২০৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য। এখান থেকে উৎপাদিত পণ্য খুব সহজেই পায়রা বন্দর দিয়ে দেশ ও বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও অর্থনৈতিক জোন প্রকল্পের প্রধান পবন চৌধুরী নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করেছেন।