28 C
Dhaka
নভেম্বর ২২, ২০২৪
Bangla Online News Banglarmukh24.com
অর্থনীতি জাতীয় প্রচ্ছদ

বাংলাদেশের ‘সবুজ প্রবৃদ্ধি’ ও ‘ন্যায্য বাণিজ্যে’র কৌশল

নিঃসন্দেহে গতানুগতিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রয়েছে অসামান্য অর্জন। কিন্তু বিশ্বজুড়েই গতানুগতিক এই অগ্রগতির বিপরীতে বইছে নয়া ধাঁচের এক অর্থনীতি গড়ার আন্দোলন। সেই অর্থনীতি সবুজ, প্রযুক্তিনির্ভর এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক। এই নয়া অর্থনীতির মূলে রয়েছে আমাদের প্রিয় প্রকৃতি তথা পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসা, সমাজ ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ, প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার এবং সব মিলিয়ে প্রান্তজনের ভালোভাবে খেয়ে-পরে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ সৃষ্টির আহ্বান। বছর দুই আগে জাতিসংঘে সারা বিশ্বের নেতারা টেকসই উন্নয়নের জন্যে ১৭টি লক্ষ্য পূরণের অঙ্গীকার করেন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো পূরণের মেয়াদ শেষের পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে এই ১৭টি লক্ষ্য পূরণে এক বিশ্ব সমঝোতায় নেতৃবৃন্দ পৌঁছুতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঐ লক্ষ্যমালায় অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয়গুলোর গভীর আন্তঃসম্পর্কের কথা মনে রেখে ন্যূনতম কিছু টার্গেট পূরণের অঙ্গীকার করেছিলেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। বৈশ্বিক এই উন্নয়ন পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখেই তার কয়েকদিন বাদেই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ প্যারিসে জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর সকল দেশের সরকারপ্রধানই পরিবেশ সংরক্ষণের অংশ হিসেবে জলবায়ু চুক্তিতে ঐক্যমতে পৌঁছুতে পেরেছিলেন। মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার এক নজিরবিহীন সহমর্মিতা প্রদর্শন করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলাদেশ জাতিসংঘের নেওয়া উভয় উদ্যোগের প্রথম সারির সক্রিয় সদস্য দেশ হিসেবে তার অবদান রাখতে পেরেছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ দুটো বিশ্বচুক্তির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার ঝুঁকিপূর্ণ প্রথম ১০টি দেশের প্রথমদিককার একটি দেশ বাংলাদেশ। তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই পরিবেশের পক্ষে নেওয়া জাতিসংঘের উভয় উদ্যোগের অন্যতম উদ্যোক্তা যে বাংলাদেশই হবে সে প্রশ্নে দ্বিমতের অবকাশ নেই।
তবে গত দু’বছরে পৃথিবী অনেকটাই বদলে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়া ছিল এক ঐতিহাসিক বিশ্ব বিপর্যয়। তিনি নির্বাচিত হয়েই জাতিসংঘের ওপর চড়াও হলেন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের যে সমর্থন ছিল তা প্রত্যাহার করে নিলেন। একই সঙ্গে জাতিসংঘের ওপর নানা চাপ সৃষ্টি করছেন। চাঁদা কমিয়ে দেবার হুমকি দিচ্ছেন। তবে ফ্রান্সে ম্যাকরন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনও জলবায়ু চুক্তির পক্ষেই রয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট ও নাগরিক সমাজ জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সম্বন্ধে সম্যক অবহিত বলে প্যারিস চুক্তির পক্ষেই রয়েছে। তারা নিজেরাও সাধ্যমতো জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অংশগ্রহণ করছেন।
এমন টালমাটাল অস্থির পৃথিবীতে আগামী প্রজন্মের জন্যে বাসযোগ্য এক টেকসই পৃথিবী গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সামনের দিকে। তা সত্ত্বেও একথা বললে বোধ হয় ভুল হবে না যে বাংলাদেশ এখনও সুস্পষ্টভাবে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সবুজ প্রবৃদ্ধির কৌশলটি পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করে উঠতে পারেনি। সুনির্দিষ্ট সবুজ প্রবৃদ্ধির কৌশল এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট নিয়মনীতি, প্রতিষ্ঠান ও আন্তঃখাত সমন্বয় কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত না করার কারণে পরিবেশ দূষণ বেড়েই চলেছে। আর এই দূষণের বাড়তি মূল্য অর্থনীতি ও সমাজকে গুনতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বাড়তি চাপের কারণে আমাদের অর্থনীতির ভঙ্গুরতা বাড়ছেই। আর্থিক বিচারে আমরা এক যুগ পরেই নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবার স্বপ্ন দেখছি। তার এক দশক পরেই (২০৪১) বাংলাদেশের উন্নত দেশ হবার কথা। এ স্বপ্ন পূরণে আমাদের প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার আট শতাংশের ওপরে নিয়ে যেতে হবে। বাড়ন্ত এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে যে পরিমাণ জ্বালানি ও অবকাঠামো লাগবে তা নিশ্চিত করতে গিয়ে আমরা যেন প্রকৃতি ও পরিবেশের বড় ক্ষতি না করে ফেলি সেদিকে কড়া নজর রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের বাড়তি চাপ মোকাবিলার জন্যে বিপন্ন মানুষের বাঁচার নয়া কৌশল ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে নয়া ধাঁচের সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। নয়া ধাঁচের নিয়মনীতি ও প্রতিষ্ঠান গড়ে না তোলা গেলে পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধির ধারা অক্ষুণ্ন রাখা বেশ মুশকিলই হবে বলে আশঙ্কা হয়।
বাংলাদেশসহ হাল আমলে যেসব দেশ আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে সেগুলোর মধ্যে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার নাম করতে হয়। এসব দেশ মূলত উদার বাণিজ্যের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে সস্তা মূল্যে রপ্তানিনির্ভর শিল্পায়নে ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। এসব দেশে তাই অগোছালো নগরায়নও ঘটেছে। বড় বড় শহর ও বন্দরের আশ-পাশে রপ্তানিমুখী শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। গ্রাম থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়েসী শ্রমিক (মূলত নারী) এসব শিল্পে কাজ খুঁজে পেয়েছেন। এতো দ্রুত সুষ্ঠুভাবে নগরায়ন সম্ভব হয়নি বলে এই প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা, বাসস্থান, যাতায়াতসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে বাড়তি মানুষের চাপে এসব দেশের পরিবেশ প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। নগর ও আধা-নগরে বাস করাই এখন মুশকিল হয়ে গেছে। আর সে কারণেই এই রপ্তানি পণ্যের বিদেশি ভোক্তারা জোর দাবি তুলছেন পরিবেশসম্মত ন্যায্য বাণিজ্যের পক্ষে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর সারা বিশ্বেই পরিবেশসম্মত কারখানা ও শ্রমিকদের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করার পক্ষে বিশাল জনমত গড়ে ওঠে। এই চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ সরকার, রপ্তানিকারক উদ্যোক্তা, গার্মেন্টস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর জোট ও শ্রমিকদের ইউনিয়নসমূহ একসঙ্গে কাজ করার এক নয়া সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। এই অভিযাত্রায় বাংলাদেশ ব্যাংক সবুজ অর্থায়নের নানা উদ্ভাবনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করে বিশ্বে এক নয়া নজির স্থাপন করেছে। এ জন্যে পুনঃঅর্থায়ন ছাড়াও নিজস্ব রিজার্ভ থেকে দু’শ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ‘সবুজ রূপান্তর তহবিল’ তৈরি করেছে বাংলাদেশ। গার্মেন্টস ও চামড়া শিল্পের কারখানাগুলোকে পরিবেশসম্মত করার লক্ষ্যেই এই রূপান্তর তহবিল সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ছাড়াও জাইকার সমর্থন নিয়ে ক্ষুদে ও মাঝারি আকারের গার্মেন্টস কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশের উন্নয়ন ও জ্বালানি খরচ কমানোর জন্যে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রত্যেকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সামাজিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নত করার জন্যেও বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রুডেন্সিয়াল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন ইস্যু করেছে। প্রত্যেক ব্যাংককে সবুজ জ্বালানি ও পানির উপযুক্ত ব্যবহারের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজে সোলার বিদ্যুতের বড় প্যানেল তার ছাদে স্থাপন করেছে এবং বিচক্ষণতার সাথে পানি ও জ্বালানি ব্যবহারে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ইড্কলের অর্থায়নে প্রায় ৪৫ লক্ষ পরিবার এখন সোলার প্যানেল থেকে জামালপুরের সরিষাবাড়িতে জ্বালানি সংগ্রহ করে। বড় আকারের সোলার প্যানেল থেকে গ্রিড বিদ্যুত্ সরবরাহের উদ্যোগও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুপ্রেরণায় ব্যক্তিখাতের একটি প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করেছে। বিশ্বমানের সবুজ গার্মেন্টস কারখানা স্থাপনেও বাংলাদেশ ব্যাংক তার পুনঃঅর্থায়নের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবুজ অর্থায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারও তার বাজেট থেকে পরিবেশ সহায়ক তহবিল তৈরি করেছে। বিদেশি সংস্থা থেকেও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবে এই তহবিল সংগ্রহের গতি খুবই শ্লথ। সম্প্রতি ইড্কল ও পিকেএসএফ জাতিসংঘের জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য বাস্তবায়ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এত সব কিছু সত্ত্বেও এ কথা বলা যায়, সবুজ প্রবৃদ্ধির জন্য আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগগুলো এখনো খাপছাড়াই রয়ে গেছে। এদিক থেকে ভারত ও চীন বেশ দ্রুত সবুজ প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটছে। তাদের কর্মসূচিগুলো মূল ধারার নীতিমালার সঙ্গে সমন্বিত। বিশেষ করে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উত্পাদনে উভয় দেশই নিত্যনতুন উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। তবে বাংলাদেশও নানা ধরনের উদ্ভাবন করে চলেছে। ব্যক্তিখাত, এনজিও, নারী উদ্যোক্তা— সকলেই পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে নিজেদের মতো করে উদ্ভাবনীমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে। এখন দরকার একটি সমন্বিত কৌশল এবং পর্যাপ্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা করা। আর সে কারণেই দরকার ভিশনারি কিছু নীতি ভাবনা ও কর্মকৌশলের। আমাদের প্রবৃদ্ধি যেহেতু মূলত রপ্তানিনির্ভর তাই বাংলাদেশকে সাজাতে হবে সবুজ পণ্য তৈরির দেশ হিসেবে। বস্ত্র ও চামড়াখাতের কারখানাগুলোকে সবুজ কারখানায় রূপান্তরের উদ্যোগের পাশাপাশি এনজিও ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে যে সব অভিনব সবুজ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সেগুলোর প্রসার ও তাদের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সমর্থনের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। গতানুগতিক শিল্পায়নের মাধ্যমে বর্তমানের বিশ্বভোক্তাকে আকর্ষণ করা কঠিনই হবে। যদি সারা বিশ্বে একথাটা বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরতে পারি যে, আমরা পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে, সমাজে কোনো বাড়তি চাপ সৃষ্টি না করে, প্রাকৃতিক সম্পদকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে বরং পরিবেশসম্মতভাবেই আমাদের রপ্তানি পণ্যগুলো তৈরি করছি এবং বাণিজ্য করছি তাহলে ‘সবুজ বাংলাদেশ’ নামে এক নয়া ব্র্যান্ড তৈরি করা সম্ভব হবে। প্রচলিত বড় বড় কারখানা রূপান্তরের পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি এনজিও কিংবা ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের সবুজ পণ্য উত্পাদনে যদি আমরা উত্সাহিত করতে পারি তাহলে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হবে। সবুজ অর্থনীতির দেশ হিসেবে নতুন প্রজন্মের বিশ্ব ভোক্তারা বাংলাদেশের পণ্য ভোগ করতে উত্সাহী হয়ে উঠবে।

সম্পর্কিত পোস্ট

কুরআনের আয়াত পোস্টের সঙ্গে ২ ছবি শেয়ার, কী বার্তা দিলেন আসিফ নজরুল

banglarmukh official

সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়াকে সম্মান জানানোয় গোটা জাতি আনন্দিত

banglarmukh official

অবরুদ্ধ পেট্রোবাংলা, ভেতরে আটকা শত শত কর্মকর্তা

banglarmukh official

গরুর মাংসের দাম এখনও নাগালের বাইরে: ফরিদা আখতার

banglarmukh official

কুইক রেন্টালে দায়মুক্তি অবৈধ: হাইকোর্ট

banglarmukh official

শহিদি মিছিলে যুক্ত হলেন আরও এক শিক্ষার্থী

banglarmukh official