অনলাইন ডেস্ক:
চাহিদানুযায়ী কোন ঘাটতি না থাকলেও বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে বরিশাল মহানগরীসহ দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ উপজেলায় বিদ্যুৎ সংকটে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। জরুরি চিকিৎসা সেবাসহ পানি সরবরাহ এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
তাপমাত্রার পারদ ওপরে ওঠার সাথে সাথে বিদ্যুৎ সংকটও বাড়ছে। অথচ কোন ঘাটতি নেই। আসন্ন গ্রীস্মের গরমের সাথে রমজানে দুর্ভোগ কোন পর্যায়ে পৌঁছবে তা নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন বিদ্যুত গ্রাহকরা। গত কয়েকদিনের বর্ষণে বিদ্যুত বিভ্রাট লেগেই রয়েছে। আকাশে মেঘ দেখলেই বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ১২ থেকে ১৫ ঘন্টা পরেও তা চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করছেন না সংশ্লিষ্ট বিভাগ। সর্বশেষ বুধবার বিকেল থেকে বন্ধ করে দেয়া বিদ্যুত সরবরাহ চালু করা হয় বৃহস্পতিবার দুপুরে।
সূত্রমতে, সাম্প্রতিককালের তীব্র শৈত্যপ্রবাহের মধ্যেও বরিশাল মহানগরীর অনেক এলাকাতেই বিদ্যুৎ নিয়ে দুর্ভোগে পরতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। শীত বিদায়ের পর বসন্তের ভরা মৌসুমেই বিদ্যুৎ নিয়ে জনগণের দুর্ভোগ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে ঘাটতিসহ দায়িত্বশীলদের কর্তব্যে উদাসীনতা আর জনবল সংকটে পরিস্থিতি ক্রমশ নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অধিকাংশ সময়ই পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক ফিডারে ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকছে। ফলে মানুষের দুর্ভোগ সব সীমা অতিক্রম করেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের ছয়টি জেলায় বিদ্যুৎ চাহিদা রয়েছে প্রায় ১৩৫ মেগাওয়াট। আসন্ন গ্রীস্মে তা ১৬৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত পৌঁছাবে বলে আশা করছেন কর্তৃপক্ষ। বরিশালের কোথাও বিদ্যুতের কোন ঘাটতি ছিলোনা। পুরনো বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার সাথে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। খোঁদ বরিশাল মহানগরীর প্রায় সব ১১ ও .০৪ কেভি বিতরণ লাইনগুলো ৩০ বছরেরও বেশি পুরনো। অনেক বিতরণ ট্রান্সফর্মারই ওভারলোডেড হয়ে আছে। জনবলের সংকটের কারণে এসব ট্রান্সফর্মারের তেল পরিবর্তনসহ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছেনা। আসন্ন গ্রীস্মে আরও অধিক সংখ্যক ট্রান্সফর্মারই ওভারলোডেড হয়ে পুড়ে যাবার আশঙ্কাও রয়েছে।
তবে সাম্প্রতিককালে পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার দায়িত্বে নিয়োজিত ‘ওজোপাডিকো’ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি ভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়নে কাজ করছে। এর আওতায় বরিশাল মহানগরীসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলা সদর ও কয়েকটি উপজেলা সদরে বিদ্যুৎ বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার কিছু উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় বরিশাল মহানগরীর রূপাতলী ৩৩ কেভি সাব-স্টেশনটির পুনর্বাসন কাজ চলছে। এ প্রকল্পের আওতায় নতুন ভবনে সাব-স্টেশনটির সব সরঞ্জামাদি স্থানান্তর কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে। এখানে ২২ এমভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ৩৩/১১ কেভি ট্রান্সফর্মারও স্থাপন করা হয়েছে। ফলে রূপাতলী সাব-স্টেশন থেকে ৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া কাশিপুর ও পলাশপুর সাব-স্টেশনগুলোও পুনর্বাসন করা হচ্ছে। বরিশাল নগরীতে চারটি ৩৩/১১ কেভি সাব-স্টেশনে সংযুক্ত প্রায় ২৮টি ফিডারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ওজোপাডিকো।
নগরীর কিছুকিছু বিতরন ও সরবরাহ লাইনও পরিবর্তন হচ্ছে। রূপাতলী-কাশীপুর ৩৩ কেভি লাইনটি পুনর্বাসন কাজও প্রায় শেষপর্যায়ে। তবে এসব লাইন ভূগর্ভস্থ ক্যাবলে রূপান্তরের তাগিদ রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলের। নগরীর চাঁদমারী ও নবগ্রাম রোডে আরও দুটি ৩৩/১১ কেভি সাব-স্টেশন নির্মাণের কথা রয়েছে প্রকল্পের আওতায় কিন্তু জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বিলম্বের কারণে নবগ্রাম রোডের সাব-স্টেশনটির কাজ শুরু করতে আরও কমপক্ষে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ১১/.০৪ কেভি ট্রান্সফর্মারও পরিবর্তন করা হচ্ছে। তবে তা পুরনো ট্রান্সফর্মার পুড়ে যাওয়ার পরে। প্রায় সব ১১ কেভি ট্রান্সফর্মারই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এমসিপিসহ ড্রপ আউটের অভাবে। এখনও এ নগরীর একটি ট্রান্সফর্মারের ফিউজ পুড়ে গেলে পুরো ফিডারই বন্ধ করতে হয়। ১১ কেভি লাইনগুলোতে ইতোপূর্বে কিছু আইসোলেটর স্থাপন করা হলেও তার বেশিরভাগই অকার্যকর। ৩৩ কেভি লাইনগুলোর ইনস্যুলেটর ও পিনগুলো দীর্ঘদিনের পুরনো। ১০ কিলোমিটার বেগে বাতাস ছাড়লেই বরিশাল মহানগরীসহ জেলার অধিকাংশ উপজেলার ৩৩ কেভি লাইনগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নগরীসহ দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ জেলা ও উপজেলার সদরের বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছেনা। অবশ্য এজন্য ব্যাপক জনবল সংকটের কথাও জানিয়েছেন ওজোপাডিকোর দায়িত্বশীল মহল।
এসব পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পাশাপাশি বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত করারও দাবি রয়েছে সাধারণ মানুষের। নতুন সংযোগ গ্রহণ থেকে পুরনো সংযোগগুলোর মিটার পরিবর্তনে একজন গ্রাহককে যথেষ্ট দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, দালাল না ধরলে ওজোপাডিকোর নতুন সংযোগ পাওয়া কঠিন। এমনকি ডিজিটাল মিটার স্থাপনের পরে ছয় মাস থেকে বছরের মাথায় এসব মিটার বিকল হয়ে যাচ্ছে। আর ওইসব মিটার পরিবর্তনে গ্রাহককে নিজের টাকায় নতুন মিটার সংগ্রহ করার পাশাপাশি সাড়ে তিনশ’ টাকা জমাও দিতে হচ্ছে। আর এ পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতেও অনেক ক্ষেত্রে দালাল ধরতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
অপরদিকে বরিশাল নগরীসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ইন্টারনেটের ব্রডব্যান্ড লাইনসহ ক্যাবল টিভির লাইনগুলোতে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে তার প্রায় পুরোটাই অবৈধভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এই অবৈধভাবে ব্যবহার করা বিদ্যুতের পুরোটাই চুরি হচ্ছে। এর সাথে মাঠপর্যায়ের কর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিতরণ বিভাগের দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধেও সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব বিষয়ে ওজোপাডিকোর বিভিন্ন বিতরণ বিভাগ ও তার তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা দৃঢ়ভাবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।