বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি কেনার প্রস্তাব করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ৫৪১টি নতুন আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি কিনতে ধরা হয়েছে এই ব্যয়। তবে প্রস্তাবনায় এসব যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য কোনো জনবল নিয়োগ কিংবা আউটসোর্সিংয়ের সংস্থানের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ’ প্রকল্পের আওতায় এ প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবটি এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে চসিক। প্রকল্পটি অনুমোদনের পর চার বছর মেয়াদে বাস্তবায়ন করবে চসিক। তবে জনবল ছাড়াই চসিকের প্রস্তাবিত এমন প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রকল্পে বিপুল সংখ্যক যান-যন্ত্রপাতি সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত চালক প্রয়োজন। কিন্তু প্রকল্পের জনবল কাঠামোতে জনবল নিয়োগ ও আউটসোর্সিংয়ের সংস্থান নেই। বিপুলসংখ্যক যান-যন্ত্রপাতি কীভাবে পরিচালনা করা হবে তা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। কারণ দক্ষ জনবল না থাকলে যন্ত্রপাতি পরিচালনার বদলে পড়ে থাকবে। এতে সরকারি টাকার অপচয় হতে পারে বলে মত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
কমিশন জানায়, প্রকল্পে পাঁচটি পিকআপ কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। যেহেতু প্রকল্পে অতিরিক্ত জনবল নেই, সেহেতু গাড়িগুলো বাদ দেওয়া যেতে পারে। প্রকল্পের প্রতিটি আইটেমের দরের ভিত্তি হিসেবে বাজারমূল্য উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক এ পণ্যগুলোর বাজারমূল্য কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে তা জানতে চেয়েছে কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশনের যুগ্ম প্রধান (ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ণ উইং-২) মো. উবায়দুল হক জাগো নিউজকে বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বড় আকারে আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু জনবলের কথা বলা হয়নি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্তমানে যে জনবল আছে তারা কোনো না কোনো কাজ করছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনার পর এগুলো পরিচালনা করা হবে কীভাবে? জনবল না থাকলে এসব আধুনিক যন্ত্রপাতি পড়ে থাকতে পারে। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হবে। সে কারণেই মূলত জনবলের বিষয়টি জানতে চেয়েছি চসিকের কাছে।
প্রকল্প নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন তুলে কমিশন জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পে যে যান-যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হবে তার প্রতিটির সঙ্গে খুচরা যন্ত্রাংশ কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে যান-যন্ত্রপাতি ও খুচরা যন্ত্রাংশের ব্যয় নির্ধারণ করায় সঠিক ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে না। যান-যন্ত্রপাতি থেকে খুচরা যন্ত্রাংশের প্রাক্কলিত ব্যয় আলাদাভাবে প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রতিটি যন্ত্রের ইকোনমিক লাইফ টাইম যথাযথভাবে বিবেচনা করে প্রকল্পের আয়-ব্যয় বিশ্লেষণ করতে হবে।
নতুন যান-যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হবে বিধায় প্রতিটি যান-যন্ত্রপাতির কমপক্ষে এক বছরের ওয়ারেন্টি সময় থাকবে। অর্থাৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেরামত করে দেবে। এ কারণে স্পেয়ার পার্টসের সংস্থান প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। তবে একান্ত প্রয়োজন হলে সীমিত আকারে স্পেয়ার পার্টস সংগ্রহ করা যেতে পারে। ডাম্প ট্রাকের স্পেয়ার্স দরকার আছে বলে মনে হয় না। প্রকল্পে যান-যন্ত্রপাতির ব্যয় প্রাক্কলন একটি বাজারদর যাচাই কমিটির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই দর যাচাই কমিটি ব্যয় প্রাক্কলনে কী কী বিষয় বিবেচনায় নিয়েছে এবং যান-যন্ত্রপাতির একক ব্যয় ও স্পেয়ার্স পার্টসের ব্যয় সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে বলে মত কমিশনের।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্তমান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম ও যান-যন্ত্রপাতির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা দরকার বলে জানায় কমিশন। এক্ষেত্রে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জিরো বর্জ্যের বিষয়ে সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনাও জানতে চেয়েছে কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকল্প সর্বোচ্চ ২০ কোটি টাকার ক্রয় অনুমোদন করতে পারে। একইভাবে ২৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে ক্রয় সিটি করপোরেশন অনুমোদন করতে পারে না। অর্থ বিভাগের জারি করা সবশেষ পরিপত্র অনুসারে প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান সংশোধন করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় নানা ধরনের ত্রুটি রয়েছে বলে দাবি কমিশনের। প্রকল্পটি ঢাকা সিটি করপোরেশনের বলা হয়েছে। অথচ এটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পে পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে অথচ এখন অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি ঢাকা বিভাগে অবস্থিত বলা হয়েছে, যা সংশোধন করা প্রয়োজন। প্রকল্পের লগ ফ্রেমে ইনপুটও সঠিকভাবে দেওয়া হয়নি। প্রকল্পের আয়-ব্যয় বিশ্লেষণও সঠিকভাবে করা প্রয়োজন।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে সড়কে পাশে বসানো হয়েছে এসটিএস বা লোহার কন্টেইনার/ছবি: জাগো নিউজ
জনবল বাদ দিয়ে ৫৪১টি নতুন আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি কেনায় আগ্রহ
জনবল নয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনায় আগ্রহী চসিক। আধুনিক যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে ২০০টি আইপি ক্যামেরা স্থাপন, পাঁচটি মনিটরিং পিকআপ, পাঁচটি মোটরসাইকেল, ডাম্প ট্রাক তিন টনের ২৫টি, পাঁচ টনের ২৫টি, সাত টনের ১০টি, চারটি লোডার, পাঁচটি স্কিড স্টিয়ার লোডার, দুটি ছোট হুইল লোডার, তিনটি মাঝারি হুইল লোডার, একটি অ্যাম্পিবিউয়াস এক্সকেভেটর, একটি ডিমোলিশন এক্সকেভেটর।
এছাড়া দুটি গ্রিপল এক্সকেভেটর, দুটি ছোট মানের চেইন এক্সকেভেটর, দুটি মাঝারি চেইন এক্সকেভেটর, দুটি লম্বা চেইন এক্সকেভেটর, দুটি টায়ার এক্সকেভেটর, ১১টি মিনি গার্বেজ ট্রিপার, দুটি মাঝারি চেইন ডোজার, দুটি বড় চেইন ডোজার, দুটি রোড সুইপিং মেশিন, ২৬ টনের দুটি ল্যান্ডলি কম্পেক্টর, একটি ক্লিনিং জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন, ২০০টি মোবাইল ওয়েস্ট কনটেইনার, ১০টি মোবাইল ওয়েস্ট কনটেইনার কেরিয়ার, তিনটি ডাইব্রেটরি টেনডেম রোলার, তিনটি স্ট্রেটিক থ্রি হুইলার সংগ্রহ করাসহ দুটি গাড়ি রাখার শেড তৈরি করা হবে।
জনবল নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রশ্ন তোলা প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা শেখ মো. শফিকুল মান্নান সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, জনবল ছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো পরিচালনা করা সম্ভব নয়। আমরা পরিকল্পনা কমিশনের মতামতকে স্বাগত জানাই। পরিকল্পনা কমিশন যেভাবে চাইবে সেভাবেই জনবল নিয়োগ করা হবে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নানা উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে- চসিক এলাকায় সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ উন্নয়নে বর্জ্য ডিজপোজালের পরিমাণ বাড়ানো, পরিবেশবান্ধব ও মানসম্মত উপায়ে বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন ও নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থানে ডিসপোজালের ব্যবস্থা করা এবং ল্যাল্ডফিল্ডে সময়মতো বর্জ্য পৌঁছানো নিশ্চিত করা।
সূত্র আরও জানায়, নানা কারণে প্রকল্পটি গ্রহণ করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। করপোরেশনের কাজের মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বর্জ্য অপসারণের জন্য যে পরিমাণ যান-যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয় সে পরিমাণ চসিকের নেই। সিটি করপোরেশনের যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে সেগুলো দিয়ে মানসম্মত উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হয় না। বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে দৈনিক তিন হাজার ৬৩ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৫৮৫ মেট্রিক টন বর্জ্য অপসারণ সম্ভব হয়। বাকি এক হাজার ৪৭৮ মেট্রিক টন বর্জ্য অনির্ধারিত স্থানে থেকে যায়, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
এসব বর্জ্য অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা অতি জরুরি। এসব কারণে ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থা উন্নয়নে আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি ক্রয়’ শীর্ষক প্রকল্পটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বর্জ্য সম্পূর্ণভাবে, সহজে ও সুন্দরভাবে অপসারণ করা সম্ভব হবে। বর্জ্য অপসারণ সম্ভব হলে চট্টগ্রাম শহর পরিচ্ছন্ন নগরী হবে। উন্নয়ন হবে নাগরিকদের জীবনমানের।