মাত্র দেড় বছরের ছোট্ট শিশু সায়িম। সায়িমের বাবা মোহাম্মদ আলী চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি। থাকেন কারাগারের হালদা ১২ নম্বর ওয়ার্ডে। ১২-১৩ দিন চুরির মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। চট্টগ্রাম কারাগারের হালদা ভবনটি জেল রোডের পাশে হওয়ায় সেখানকার বন্দিরা উঁকি দিয়ে কিংবা একটু চিৎকার করে বাক্যালাপ করেন পরিবারের সদস্যদের সাথে। এতে কারাগারের এতো নিয়ম মানতে হয় না দর্শনার্থীদের।
শুক্রবার সকালে শিশুপুত্র সায়িমকে নিয়ে রেখা তার স্বামী মোহাম্মদ আলীর সাথে দেখা করতে আসেন। তবে স্বাভাবিকভাবে কারাগারে দর্শনার্থীদের মতো দেখার সুযোগ হয়নি তার। জেল রোডের এক স্থানে দাঁড়িয়ে সজোরে চিৎকার করছে, ‘মোহাম্মদ আলী, হালদা ১২’ ‘মোহাম্মদ আলী, হালদা ১২’। তার মানে হচ্ছে। হালদা ভবনের কোনো কারাবন্দি যদি ডাকটি শুনতে পান, তাহলে ওই কারাবন্দিকে ডেকে এনে পরিবারের সাথে দেখা করিয়ে দেন। এটি অলিখিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। মোহাম্মদ আলীর বেলাতেও তা-ই।
অনেকক্ষণ ডাকার পর মোহাম্মদ আলী কারাগারের লোহার জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ডাকে স্ত্রীকে। আর ডাকে শিশুপুত্র সায়িমকেও। ছোট্ট শিশু সায়িম এতকিছু বুঝে না। মায়ের মতো উপরের দিকে সে-ও হাত বাড়ায় বাবা বাবা বলে।
আড়াই বছরের ইরফানও এদিন মা তাসলিমার সঙ্গে আসে কারাবন্দি বাবার সঙ্গে দেখা করতে। বাবা সাগর এক মাস ধরে চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি। সাগর থাকেন কারাগারের সাঙ্গু-১২ ওয়ার্ডে। নোয়াখালীর সাগর পরিবার নিয়ে থাকতেন বায়েজিদের আরেফিন নগর এলাকায়। একটি মারামারির মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আসেন তিনি। শুক্রবার কারাগারে বাবাকে দেখতে এসে প্রচণ্ড রোদের ভেতর অপেক্ষা করছিল ইরফান। রোদের প্রখরতায় কারগারের চোখ তুলে দেখতে পারছিল না উঁচু প্রাচীরের ওপারের দালানে বন্দি বাবাকে।
সাগরের স্ত্রী তাসলিমা বলেন, আমাদের একমাত্র সন্তান ইরফান। আমি গার্মেন্টে কাজ করি। তাই অন্যদিন আসতে পারি না। সাগর গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে শুধু ‘বাবা বাবা’ করতেই থাকে ইরফান। তাই আজ নিয়ে এলাম বাবাকে দেখাতে।
১১ বছরের মরিয়মও একইদিন কারাবন্দি বাবাকে দেখতে আসে। মরিয়মের বাবা ফারুক হোসেন যমুনা-১২ নং ওয়ার্ডে বন্দি। চান্দগাঁওয়ের হামিদচর এলাকা থেকে আসা মরিয়ম বলেন, আমি বাবাকে দেখতে এসেছি। বাবা ছাড়া আমাদের দেখার কেউ নেই। বাবা জেলে আছেন, এতে আমাদের চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। টাকা দিয়ে ভেতরে দেখতে পারিনি। তাই বাইরে দিয়ে দেখতে এসেছি।
ফারুকের স্ত্রী শাহানাজ বলেন, আমার স্বামীকে শিশু নির্যাতন মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। বড় মেয়ের সঙ্গে তিন বছর বয়সী ছোট মেয়ে মিমও এসেছিল বাবাকে দেখতে। রোদের কারণে ভালমতো দেখতে পারছিল না। কথা বলতে চাইলেই কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে মিম বলেন, বাবার সাথে দেখা হয়নি। বাবাকে দেখতে মন চাচ্ছে।
শুধু সায়িম, ইরফান, মরিয়ম, মিম নয়, পরিবারের সদস্যদের বাইরে অনেক কারাবন্দির স্বজনরাও আসেন দেখা করতে। এ চিত্র শুধু শুক্রবারের নয়, চট্টগ্রাম জেল রোডের প্রতিদিনের চিত্র এটি। সকাল ৮টা থেকে সূর্যাস্ত অব্দি একানে দেখা যায় কারাবন্দিদের স্বজনদের।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দিদের জন্য বহুতল ভবন আছে ১৫টি। এর মধ্যে কারাগারের পাশে জেল রোড ঘেঁষে রয়েছে হালদা, যমুনা ও সাঙ্গু ভবন। ৬তলা বিশিষ্ট ভবনগুলোর চতুর্থ ও পঞ্চম তলার ওয়ার্ডগুলো দিয়ে জেল রোড সড়কের লোকজন দেখা যায়। মূলত কারাগারের বাইরের ১৮ ফুট উচ্চতার প্রাচীরের কারণে নিচের তিন তলা পর্যন্ত সড়ক থেকে দেখা যায় না। যে কারণে কারাগারে আসা বন্দিদের চাহিদা থাকে ভবন তিনটির চতুর্থ ও পঞ্চম তলা। তবে নিচের ওয়ার্ডের বন্দিরাও উপরের ওয়ার্ডগুলোতে উঠে স্বজনদের সাথে দেখা করেন বলে জানা যায়।
jagonews24
সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনদের দেখতে ভবনগুলোর ওয়ার্ডের জানালাতে এসে ভিড় করে কারাবন্দিরা। রাস্তা থেকে উচ্চস্বরে চিৎকারে যেমন বন্দিদের মনোযোগের চেষ্টা করেন স্বজনরা, আবার বন্দিরাও চিৎকার করে আলাপ সারেন স্বজনদের সাথে। যারা মুখের আওয়াজ শুনতে পান না, তারা হাতের ইশারায় কুশল বিনিময় করেন।
জানা যায়, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হলে ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে লকডাউন দেয় সরকার। এতে বন্ধ হয়ে যায় দেশের ৬৮টি কারাগারে বন্দিদের সাথে স্বজনদের যোগাযোগ। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ২০২১ সালের মার্চ মাসে কারাগারে স্বজনদের সাক্ষাৎ শুরু হয়। পরে এপ্রিলে করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়লে আবারও তা বন্ধ হয়। এর প্রায় ১১ মাস পর সরকারি নির্দেশে গত ২ মার্চ থেকে আবারও চালু হয় কারাবন্দিদের সঙ্গে স্বজনদের দেখা করার কার্যক্রম।
কারা সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বর্তমানে ৭ হাজার ৩শর মতো কারাবন্দি রয়েছেন। প্রতিটি সাধারণ ওয়ার্ডে ৭০-৮০ জন বন্দি রাখা হয়।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম বলেন, গত ২ মার্চ থেকে কারাবন্দিদের সঙ্গে স্বজনরা দেখা করতে পারছেন। এখন দিনে তিন থেকে পাঁচশ দর্শনার্থী আসছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দর্শনার্থীরা কারাবন্দিদের সঙ্গে দেখা করছেন। কোনো কারাবন্দির সঙ্গে স্বজনদের ১৫ দিনে একবার দেখা করার সুযোগ রয়েছে।