১৮৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বার্সেলোনা, ১৯০২ সালে রিয়াল মাদ্রিদ। প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে দুই দলের দেখা ১৯১৬ সালের কোপা দেল রে’র সেমিফাইনালে। তখন অবশ্য এতটা রেষারেষি ছিল না দুইপক্ষে। তিন বছরের ছোট-বড় এই দুই ক্লাবের মধ্যে বৈরিতার শুরু ১৯৩০-এর দশকে।
স্প্যানিশ স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রাংকো ক্যু করে ক্ষমতা দখল করার পর কমিউনিস্ট, বিচ্ছিন্নতাবাদী, স্বাধীনতাকামীসহ আর যাদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছিলেন, তাদের ভেতর কাতালানরাও ছিল। ফ্রাংকোর সেনাদের হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে বার্সেলোনা ক্লাবের প্রেসিডেন্টকেও। ১৯৩৬ সালের কোপা আমেরিকার ফাইনাল আর ১৯৪৩ সালের সেমিফাইনাল, এই দুটি ম্যাচকে ঘিরে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহই দল দুটিকে পরিণত করে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীতে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক কিছুই যোগ হয়েছে ইতিহাসের এই অধ্যায়ে, তবে একটি ব্যাপারে অনেক দিন ধরে এগিয়ে ছিল রিয়াল মাদ্রিদ। সেটা এল ক্লাসিকো জয়ের সংখ্যায়। প্রতিযোগিতামূলক ‘এল ক্লাসিকো’ ম্যাচে ১৯৩২ সাল থেকে জয় সংখ্যায় এগিয়ে ছিল রিয়াল, ৮৭ বছর পর তাদের টপকে গেল বার্সেলোনা। রিয়ালের ৯৫ জয় ছাপিয়ে বার্সার জয় সংখ্যা এখন ৯৬। সবশেষ শনিবার রাতে, সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ইভান রাকিটিচের একমাত্র গোলে রিয়ালকে হারাল বার্সা।
সাম্প্রতিক অতীতে অবশ্য রিয়ালের চেয়ে বার্সার জয়ের পাল্লাই ভারী। ২০১৭ সালের স্প্যানিশ সুপার কাপের দুটি লেগেই জিতেছিল রিয়াল, এরপর মাদ্রিদের অভিজাতরা আর পেরে ওঠেনি কাতালানদের সঙ্গে। বর্তমান মৌসুমে লা লিগার দুটি ম্যাচের ফল যথাক্রমে ৫-১ এবং ১-০।
কোপা দেল রে’তে সেমিফাইনালে দেখা হয় দুই দলের, ফল ১-১ এবং ৩-০। এল ক্লাসিকোয় ক্রমশ রং হারাতে থাকা রিয়াল তাই শেষ পর্যন্ত খুইয়েই ফেলে জয়ের সংখ্যায় এগিয়ে থাকার অতীত গৌরবের মুকুটটা। ৯৬ জয় নিয়ে রিয়ালকে পেছনে ফেলে দিল কাতালানরা। ফেব্রুয়ারির ৬ থেকে মার্চের ২—এই ২৪ দিনে তিনবার মুখোমুখি হয়েছে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। রিয়াল জিততে পারেনি একবারও। সবশেষ ম্যাচের ২৬ মিনিটে রাকিটিচের করা একমাত্র গোলেরও কোনো জবাব ছিল না সান্তিয়াগো সোলারির দলের কাছে। সের্গি রবার্তোকে পাস দিয়ে সামনে ছোটেন রাকিতিচ, রবার্তো ফের পাস দেন তাঁকেই। অনেকটাই মেসিসুলভ ড্রিবলিংয়ে ডান প্রান্ত দিয়ে ঢুকে স্লাইড করে আসা ডিফেন্ডারের শরীরের ওপর দিয়ে বলটা জালে পাঠিয়ে দেন ক্রোয়াট তারকা।
এল ক্লাসিকো মানেই উত্তেজনা, স্নায়ুর চাপ। রামোসের সঙ্গে মাঠে অনেকবারই লেগে গেছে মেসির। রামোস মেসির মুখে চাপ দিয়ে ধরেছেন, জেরার্দ পিকে তো বলেছেন নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল মেসির। রামোস পরে বলেছেন, ‘খেলায় এমন হয়ই।’ পিকে খেপে গিয়ে বলেছেন, ‘লিওর মুখে রক্ত চলে এসেছিল। পরিষ্কার আগ্রাসী আক্রমণ।’
গত বছরের শেষ দিকেই সান্তিয়াগো সোলারির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদটা বাড়িয়ে ২০২১ পর্যন্ত করেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। তবে দুটি ক্লাসিকোয় নখদন্তহীন পারফরম্যান্স হয়তো এই মৌসুম শেষেই এই আর্জেন্টাইনকে মাদ্রিদ ছাড়তে বাধ্য করবে। শুধু তা-ই নয়, আঙুল উঠছে রিয়ালের বেশ কজন জ্যেষ্ঠ ফুটবলারের দিকে। তাঁদের মধ্যে আছেন টোনি ক্রোস, গ্যারেথ বেল, করিম বেনজিমা। রিয়ালের অধিনায়ক সের্হিও রামোস দুষছেন আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের, ‘আমাদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়তো নয়, তবে সত্যি কথাটা হচ্ছে আগের দিনের মতোই আমরা সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত ফুটবল হচ্ছে গোলের খেলা। আমরা সুযোগ পেয়েছিলাম, কিন্তু গোল করতে না পারলে সব কিছু হাতছাড়া হতে থাকবে।
স্প্যানিশ ফুটবল বিশেষজ্ঞ হোসে ফেলিক্স দিয়াসের বিশ্লেষণ, ‘রিয়ালের গোল করার মানুষ যদি হয় ভিনাসিয়াস আর রেগালো, তাহলে কোথাও একটা সমস্যা আছে। তাদের বয়স হচ্ছে ১৮ এবং ২২ বছর, তারা হচ্ছে সবচেয়ে কম বয়সী দুজন অথচ তারাই নাকি প্রতিপক্ষের সবচেয়ে বড় হুমকি!’ ১৮০ মিনিট ধরে রিয়াল সমর্থকরা দেখলেন অক্ষম এক রিয়াল মাদ্রিদকে, যারা বার্সেলোনার জালে একবারও বল পাঠাতে পারেনি। ২০১৭ সালে সুপার কাপে বেনজিমার গোলের পর বার্নাব্যুতে আর গোল হয়নি ক্লাসিকোতে, সব মিলিয়ে ৩০০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে নিজ মাঠে বার্সার বিপক্ষে গোল করতে পারছে না রিয়াল। হারের পর সোলারির অকপট স্বীকারোক্তি, ‘আমরা আমাদের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করেছি, হাল ছেড়ে দিইনি। গোল না করলে জেতা যাবে না।’ জিতে রিয়ালের সঙ্গে ব্যবধানটা ১২ পয়েন্টের করে ফেলল বার্সেলোনা।
২৬ ম্যাচে ৬০ পয়েন্ট নিয়ে তারা শীর্ষে, সমান ম্যাচে ৪৮ পয়েন্ট নিয়ে তিনে রিয়াল আর মাঝে ২৫ ম্যাচে ৫০ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদ।