আজ থেকে ১৮ বছর আগের কথা। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানী ঢাকায় বসেছিল এশীয় অনূর্ধ্ব-১৭ যুবাদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। দিনটি হয়তো ১৩ কিংবা ১৪ ফেব্রুয়ারি। পড়ন্ত বিকেলে রাজধানী ঢাকা তথা দেশের ক্রীড়াতীর্থ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে পাশাপাশি প্র্যাকটিস করছিল বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৭ দল ও পাকিস্তানের যুবারা।
সেন্টার উইকেটের পাশ ঘেঁষে সবুজ গালিচার মতো আউটফিল্ডে নক করছিলেন ওই আসরে বাংলাদেশের অধিনায়ক নাফিস ইকবাল। একটু দূরে প্রায় একইভাবে ব্যাটিং প্র্যাকটিসে মেতেছিলেন ওই আসরে পাকিস্তান ক্যাপ্টেন নন্দিত-নিন্দিত সালমান বাট। এখনকার মতো তখন এতো নিয়মের কড়াকড়ি ছিল না। সাংবাদিকরা মাঠের ভেতরে দাঁড়িয়েই প্র্যাকটিস দেখতে পারতেন।
আমিসহ হাতেগোনা কয়েকজন ক্রিকেট লেখক ও সাংবাদিক নাফিস ইকবাল আর সালমান বাটের ব্যাটিং দেখছিলাম। হঠাৎ ভিআইপি স্ট্যান্ড থেকে এগার-বার বছরের এক উচ্ছ্বল কিশোর দৌড়ে মাঠে ঢুকলেন। তারপর লাজ-নম্র চোখে অপলক দাঁড়িয়ে ব্যাটিং প্র্যাকটিস অবলোকন করলেন।
জানেন কে সেই উচ্ছ্বল কিশোর? কি তার নাম? সেদিনের সেই ১২ বছরের কিশোর আর কেউ নন, বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবিসংবাদিত ব্যাটিং প্রতিভা তামিম ইকবাল।
বড় ভাই নাফিস ইকবালের দিকেই নজর ছিল তার। হঠাৎ সেখানে এসে উপস্থিত নাফিস-তামিমের চাচা আকরাম খান। সৌজন্যতা বিনিময়ের পর ভাতিজা তামিমকে দেখিয়ে আকরাম সাংবাদিকদের বলে বসলেন- ‘আমার ছোট ভাতিজাকে চিনে রাখুন। ও আমার আর নাফিসের মতো ডানহাতি নয়, বাঁ-হাতি। অনেক জোরে মারতে পারে। এত জোরে আমিও পারি না!’
আকরামের ওই কথা শুনে ভেবেছিলাম, ভাতিজার প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা আর দুর্বলতা থেকেই এমন প্রশংসা স্তুতি হয়তো; কিন্তু পরে ঠিকই বুঝলাম, আসলেই তামিম ‘হার্ডহিটার’। চাচার চেয়েও জোরে মারতে পারেন। চার-ছক্কা হাঁকানো যার বাঁ-হাতের খেল।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের খুঁটিনাটি খোঁজখবর যাদের নখদর্পনে, তারা সবাই জানেন, মানেনও- আকরাম খানই গত দুই যুগের বেশি সময়ে সবচেয়ে ‘পাওয়ারফুল হিটার।’ লং অফ, লং অন আর ডিপ মিড উইকেটের উপর দিয়ে অবলীলায় অনায়াসে ছক্কা হাঁকাতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন তিনি। সেই তিনিই যখন ১২ বছরের এক পুঁচকে ছেলেকে দেখিয়ে বললেন- আমার চেয়ে জোরে মারতে পারে, তখন বিস্ময়ের জন্ম নিয়েছিল বৈকি!
কিন্তু কয়েক বছর পর সেই তামিম যখন ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন এবং সবার নজর কাড়লেন, তখনই জানা হলো- সত্যিই, বিগ ও পাওয়ার হিটিংটা অনেক ভালোই পারেন ‘জুনিয়র খান সাহেব।’
তামিমের উদয়লগ্নই ছিল সে রকম বার্তা দিয়ে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে নিজের প্রথম আসরেই ঝড় তুলেছিলেন। আগমনী বার্তা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন ২০০৬ সালেই। চাচা আকরাম খানের নেতৃত্বে ওল্ডডিওএইচএসের হয়ে শুরুতেই ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছিলেন তামিম। সেবার এক ম্যাচে প্রায় ডাবল সেঞ্চুরিই করে ফেলেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত থামেন ১৮৮ রানে। ঘরোয়া লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে এটাই এখনও পর্যন্ত সেরা ইনিংস। বেশিরভাগ ম্যাচেই ওই অতটুকু বয়সের তামিমের স্ট্রাইকরেট থাকতো ৯০’র আশপাশে।
শুরুর দিকে তামিম মানেই ছিল তেড়েফুঁড়ে বিগ হিট হাঁকাতে যাওয়া এক সাহসী যুবা। তামিম মানেই যে কোনো সময় যাকে তাকে চার-ছক্কা হাঁকাতে ব্যাকুল এক উইলোবাজ। তার প্রমাণ জানতে চান? তাহলে শুনুন- সেটা ছিল তার ক্যারিয়ারের পাঁচ নাম্বার ওয়ানডে আর বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ। তাও মহাপরাক্রমশালী ভারতের বিপক্ষে। জহির খান, মুনাফ প্যাটেল, হরভজন সিং, যুবরাজ সিং, অজিত আগারকারদের মতো বিশ্বমানের বোলারদের তুলোধুনো করে তামিম হাঁকিয়েছিলেন ৫১ রানের ঝড়ো ইনিংস। ৯৬.২২ স্ট্রাইকরেটে ৫৩ বলে করা ওই ইনিংসে ছিল ৭টি চার ও ২টি বিশাল ছক্কার মার।
এর আগে একদিনের ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে তামিমের ব্যাট থেকে এসেছিল ৩ চার ও ২ ছক্কায় ৩২ বলে ৩০ রানের ঝড়ো ইনিংস। তারপর ২০০৭ সালের মে মাসে শেরে বাংলায় ভারতের বিপক্ষে আবার ৫৩ বলে ৬ বাউন্ডারিতে ৪৫ এবং ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ২০ নাম্বার ম্যাচে ৪৯ বলে ৪৩ রানের আরও একটি ঝকঝকে ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
প্রথম সেঞ্চুরি করেছেন ৯৫.৮৫ স্ট্রাইকরেটে। ২০০৮ সালের ২২ মার্চ শেরে বাংলায় আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩৬ বলে ১৫ বাউন্ডারি আর ১ ছক্কায় করেছিলেন ১২৯ রান।
তার ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে ভাবা হয়েছিল, তামিম শুধু একদিনের সীমিত ওভারের পারফরমার। তার অতি আক্রমণাত্মক মানসিকতা আর বেশিমাত্রায় বিগ শট খেলার প্রবণতার কারণেই ওয়ানডে অভিষেকেরও (২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি) ১১ মাস পর ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল তামিমের।
পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে, টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুতে তামিম হাত খুলে খেললেও খুব দ্রুত ব্যাটিং স্টাইল পাল্টে ফেলেন। ২০০৮ ও ২০০৯ প্রথম দুই বছর একটু রয়ে সয়েই খেলেন; কিন্তু ২০১০ সালের জানুয়ারিতে রাজধানী ঢাকার শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষেই আবার ঝলসে উঠে তামিমের ব্যাট। ১৮৩ বলে (১৮ চার আর ৩ ছক্কায়) ১৫১ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলার পর তামিমের টেস্টে স্ট্রাইকরেট হয়ে যায় ৮২ থেকে ৯৭-এর ভেতরে।
এভাবেই কেটেছে অনেকদিন। এক সময় নিজেকে অনেকটাই বদলে ফেলেছেন তামিম। এখন আর উইকেটে এসেই আগের মতো ছটফট করেন না। চার ছক্কা হাঁকাতে না পারলে ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলে অকাতরে উইকেট দিয়ে আসেন না। পরিণত-পরিমার্জিত আর পরিপাটি ব্যাটিং শৈলির মিশ্রণে তামিম নিজের চেয়ে দলের কথা ভেবেই ব্যাট করেন।
ম্যাচের কন্ডিশন ও দলের লক্ষ্য পরিকল্পনার কথা মাথায় রেখে যখন যা প্রয়োজন, তাই করেন। আর তাইতো মাঝে দুই বছরের বেশি সময় রয়ে সয়ে খেলার অভ্যাস করে ফেলা তামিম দুই মাস আগে বিপিএলের ফাইনালে ৬১ বলে ১৪১ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস খেলে সবাইকে চমকে দিয়েছেন।
সর্বশেষ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে নিয়মিতই দেখা গেছে তামিমের ব্যাট কথা বলছে। পেস বান্ধব দ্রুত উইকেটে যে স্টাইলে ব্যাট করলেন রান করা সম্ভব, তামিম সে স্টাইলেই রান করে গেছেন। করেছেন সেঞ্চুরিও। অথচ, তাকে অনুসরণ করতে পারলে বাংলাদেশ দলের অন্য ব্যাটসম্যানরাও সফর হতে পারতেন।
এই যে সময়ের সাথে সাথে নিজেকে বদলে ফেলা এবং পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলা-সেটাই তামিমকে নিয়ে গেছে অন্য মাত্রায়, বিশ্বমানে। আজ তামিম শুধু বাংলাদেশের এক নাম্বার ব্যাটসম্যানই নন, বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদেরও একজন।
সেই কিশোর তামিম ইকবালের আজ ৩০তম জন্মদিন। তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই বাঁকে আমার এবং জাগো নিউজের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। সামনেই আরেকটি বিশ্বকাপ। পরিণত তামিমের ব্যাটের দিকেই এই বিশ্বকাপে তাকিয়ে রয়েছে পুরো বাংলাদেশ। ২০০৭ সালের মত তিনি কি পারবেন, আবারও দুর্দান্ত উইলোবাজিতে পুরো ক্রিকেট জাতিকে বিশ্বের একটা মর্যাদাকর আসনে সমাসীন করতে? আপাতত সে পর্যন্ত অপেক্ষা।