করোনা আজ বিশ্ব মহামারীর নাম। পৃথিবীর উন্নত দশেগুলো করোনা ভাইরাস মোকাবেলা করতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি দেশের অর্থনীতির ওপর বড় হুমকী হয়েও দেখা দিয়েছে কোভিড-১৯ বা করোনা। গত বছরের গোড়ার দিকে চীনের একটি প্রদেশে আঘাত হানে করোনা। চীন সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ালেও ঝুঁকিতে পড়ে গোটা বিশ্ব। কোনভাবেই এর ছোবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। করোনার এই যুদ্ধ মোকাবেলা কেবল সচেতন ও সতর্কতা ছাড়া আর যেন কিছুই করার নেই। কেবল অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর মিছিল দেখছে উন্নত দেশগুলো। এতো মৃত্যুর মিছিলের মধ্যে দাঁড়িয়েও একদল মানুষ কাজ করছেন। যারা মাঠে থেকে আমাদের সচেতন করছেন, সতর্ক করছেন। নিজেদের সুরক্ষা ব্যবস্থা সেভাবে না থাকার পরও তারা দিন-রাত সেবা করছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন স্বাস্থ্য বিভাগ, পুলিশ, সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসন ও গণমাধ্যম।
পৃথিবী জুড়ে এখন কেবল একটা আওয়াজ ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন’ ‘সচেতন থাকুন, সতর্ক থাকুন’। বলা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব কিংবা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখলেই এই দুর্যোগ থেকে বাঁচ সম্ভব। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের মানুষ যদি ওই নির্দেশনা অনুযায়ী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার পরিণতি কি হবে একবার ভাবুন। করোনার কিংবা অন্যান্য রোগের চিকিৎিসা হবে কিভাবে? করোনায় মৃত্যুর মিছিলের সৎকার কে করবে? পৃথিবীর নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে? করোনার ভয়াবহতার তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে কে? খাদ্য চাহিদা মেটাবে কিভাবে? কর্মহীন এবং দুঃস্থরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এমন অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়া কঠিন হবে।
এমন প্রশ্ন যাতে না ওঠে সেজন্য সারা পৃথিবীতে একদল মানুষ জীবন বাজি রেখে কাজ করেন। সামাজিক দূরত্ব রাখার নির্দেশনার মধ্যেই তারা ঝুঁকি নিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন। যার যার পেশার বাইরেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। আর তারা ঝুঁকি নিচ্ছেন বলেই আজ পৃথিবীর এই দুর্যোগ মোকাবেলায় কিছুটা হলেই ইতিবাচক অগ্রগতির দিকে হাঁটা সম্ভব হচ্ছে। যিনি এবং যারা আমাদের নিরাপদ রাখতে নিরন্তরভাবে কাজ করে চলেছেন তাদের কাছে আমরা ঋণি হয়ে থাকবো আজন্ম। এদের একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে গণমাধ্যম। যাদের আমরা সাংবাদিক বলে চিনি এবং জানি।
সারা বিশ্বে ডাক্তার, নার্সদের মতো গণমাধ্যম কর্মীরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। আক্রান্ত অবস্থায় আছেন অনেকে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যমকর্মীরা নিবিড়ভাবে মাঠে থেকে সচেতনতা ও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছেন। পেশাগত দায়িত্বের বাইরে দাঁড়াচ্ছেন কর্মহীন ও দুঃস্থ মানুষের পাশে। এই মুহূর্তে শঙ্কা ও ভয়ে মুদ্রিত পত্রিকার প্রচার সংখ্যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। যখন জাতীয় ও আঞ্চলিক অনেক পত্রিকা করোনার ঝুঁকির কারণে তাদের মুদ্রণ বন্ধ রেখেছেন। তখনও গুটি কয়েক পত্রিকা ঝুঁকি উপেক্ষা করে সেবা করে যাচ্ছেন। বরিশালের প্রায় ৩০টি আঞ্চলিক পত্রিকার সবকটির মুদ্রণ বন্ধ রয়েছে করোনার কারণে। এক দুইটি পত্রিকা চালু রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে সবার অনলাইন চালু রয়েছে।
এই যখন বাস্তব অবস্থা তখনও কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়া স্বদর্পে মাঠে আছে। তারা ২৪ ঘন্টা আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে চলেছেন। এখানে অনুষ্ঠানভিত্তক চ্যানেলগুলোর কথা বাদ দিলেও নিউজ চ্যানেলগুলো চ্যালেঞ্জ নিয়েই মাঠে আছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সুরক্ষায় তেমন কোন ব্যবস্থা না থাকলেও তারা সেটা পাত্তা না দিয়ে নিজের ঝুঁকিকে উপেক্ষ করে কাজ করে যাচ্ছেন।
বরিশালে করোনা মোকাবেলায় গণমাধ্যমকর্মীদের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে ছিন্নমূল এবং অসহায় মানুষের পাশে রান্না করা খাবার নিয়ে উপস্থিত থাকা। গত প্রায় এক মাস বরিশালের বেশ কিছু গণমাধ্যমকর্মী বরিশাল নদী বন্দর এলাকায় থাকা দুই শতাধিক অসহায় শিশু এবং দুঃস্থদের রান্না খাবার সরবরাহ করছেন। তাদের পেশাগত দায়িত্বের বাইরে এটা এক অনন্য উদ্যোগ। তারা এটার নামও দিয়েছেন ‘উদ্যোগ’। গণমাধ্যমকর্মীদের এই উদ্যোগের সঙ্গে সহযোগী হয়ে পাশে থাকছেন সমাজের অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল এবং সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরা। তাদের সহযোগিতা নিয়ে প্রতিদিন রাতে খাবার রান্না করে ওই ছিন্নমূল ও দুঃস্থদের হাতে হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। এর বাইরেও তাৎক্ষণিক নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধ্য মতো রান্না করা খাবার দিয়ে চলেছেন তারা।
গত মাসের ১৭ তারিখ থেকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যায় লঞ্চ চলাচল। সারা দেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখার নির্দেশনা আসে হোটেলসহ সব ধরণের খাবার দোকান। এই সময় বিপাকে পড়ে বরিশাল নদীবন্দরে থাকা অসহায় ছিন্নমূল শিশুরা। দিনে-রাতে যাদের খাবার জুটতো লঞ্চ, স্টীমার কিংবা হোটেল থেকে। লঞ্চ ও হোটেলের ফেলে দেওয়া কিংবা বাড়তি খাবার জুটতো এদের ভাগ্যে। লঞ্চের সঙ্গে হোটেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এদের খাবারও বন্ধ হয়ে যায়।
বরিশাল নদীবন্দর এলাকায় করোনা সচেতনতা চালাতে গিয়ে বিষয়টি নজরে আসে গণমাধ্যমকর্মীদের। এরপরই গণমাধ্যমকর্মীরা রান্না করা খাবার নিয়ে এই অসহায়দের পাশে দাঁড়াবার চিন্তা করেন। তাদের সেই চিন্তা সফল করতে প্রথম উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসেন। তাঁর সেই একক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয় কয়েকজন সংবাদকর্মী। প্রথম দুইদিন ক্ষুদ্র উদ্যোগে চলে খাবার সরবরাহ। দুইদিন যেতেই এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হন বিডি বুলেটিনের প্রকাশক ও সম্পাদক কাজী আফরোজা। শুরুর কয়েকদিন তাদের খরচেই রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়। আস্তে আস্তে এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হন গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।
এসএম জাকির হোসেনের তত্তাবধানে বাজার করা এবং রান্না করার কাজ শেষে তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইউরেটেল বিডির একটি পরিবহন প্রতিদিন এই খাবার নদী বন্দরে পৌঁছে দেন। এর সঙ্গে তাঁর প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজন কর্মী যুক্ত থেকে কাজ করেন। এই উদ্যোগের সঙ্গে বরিশার প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ গণমাধ্যমের বরিশালের সব সংগঠনের কর্মীরা যুক্ত আছেন। তবে নিবিড়ভাবে এই উদ্যোগের সঙ্গে কাজ করছেন গণমাধ্যমকর্মী মুশফিক সৌরভ, সৈয়দ মেহেদী হাসান, রুবেল খান, মাঈনুল ইসলাম সবু