বাজারে মোটেও স্বস্তি নেই। পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগে কেনাকাটা করতে গিয়ে ক্রেতারা দেখছেন, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন ও আদার দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। অন্যান্য পণ্যের দামও আগে থেকেই বাড়তি।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদন বলছে, বাজারে অন্তত চারটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এ ছাড়া সব অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দামই বাড়তি। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব পণ্যের আমদানি মূল্য খুব একটা বাড়েনি। স্থানীয় উৎপাদনও স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও দেশে দাম বাড়ছে বেশি হারে।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে পণ্যের উৎপাদন, সর্বশেষ তিন মাসের আমদানি ও আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য বিশ্লেষণ করা হয়। এতে বলা হয়, দাম বাড়ার বড় কারণ সরবরাহ ব্যবস্থার সমস্যা। কৃষকের কাছ থেকে পণ্য ভোক্তার কাছে স্বাভাবিক সময়ের মতো পৌঁছাতে পারছে না। আবার বন্দরেও পণ্য ওঠানো-নামানো বিঘ্নিত হচ্ছে। সংস্থাটি তাদের এ প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে।
জানতে চাইলে ট্যারিফ কমিশনের সদস্য মোস্তফা আবিদ খান প্রথম আলোকে বলেন, পণ্যের মজুতে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো বাজারব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ করছে না। সাধারণ ছুটির মধ্যেও যাতে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
ট্যারিফ কমিশন যে চার পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কথা বলছে, তা হলো মসুর ডাল, পেঁয়াজ, রসুন ও আদা। কমিশনের গত শনিবারের প্রতিবেদনে বলা হয়, এক মাসে মোটা দানার মসুর ডালের দাম ১৯, মাঝারি দানা ১৩ ও সরু দানার দাম ২৮ শতাংশ বেড়েছে। ছোলার দাম বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। দেশি পেঁয়াজের দাম ২৯ শতাংশ, দেশি রসুন ৬৪ শতাংশ ও আদার দাম ৮৯ থেকে ৯৬ শতাংশ বেড়েছে।
বাজারে চালের দাম ব্যাপক চড়া। ভোজ্যতেল ও চিনির দামও বেশি। শুকনা মরিচের কেজি ২২০ টাকায় নেমেছিল। সেটা আবার বেড়ে ২৬০ থেকে ৩০০ টাকা হয়েছে। দাম কম কেবল সবজি, ডিম ও ব্রয়লার মুরগির। অবশ্য গরুর মাংসের কেজি ৬০০ টাকা। দেশি মুরগির কেজিও ৫৮০ টাকা।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব পণ্যের দাম বেশি বেড়েছে, সেগুলোর আমদানিও বেশি হয়েছে। যেমন গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মসুর ডাল আমদানি হয়েছে ৫৭ হাজার টন। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ২৪ হাজার টন বেশি। ছোলা আমদানি হয়েছে ৫২ হাজার টন, বাড়তি ৮ হাজার টন।
তিন মাসে মসুর ডালের গড় আমদানি মূল্য টনপ্রতি ১০ শতাংশ বেড়ে ৫৪৬ ডলার হয়েছে। অথচ দেশে বেড়েছে অনেক বেশি হারে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, আমদানি বেশ ভালো। কিন্তু অন্যান্য সময়ের চেয়ে চাহিদা কয়েক গুণ বেশি। অন্যান্য দেশেও চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে বৈশ্বিক বাজার দর সর্বশেষ অনেক বাড়তি।
তিন মাসে রসুন আমদানি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আগের বছরের ১৩ হাজার টনের জায়গায় এবার আমদানি হয়েছে ২২ হাজার টন। তিন মাসে গড় আমদানি মূল্য টনপ্রতি মাত্র ৩৯ ডলার বেড়ে ১ হাজার ২৪০ ডলার হয়েছে। আদার দাম বাড়েনি। টনপ্রতি গড় আমদানি মূল্য পড়ছে ৮৫৯ ডলার। আমদানি বেড়ে ২৬ হাজার টন থেকে ৩০ হাজার টন হয়েছে। কিন্তু দেশে এসব পণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে।
দেশে পেঁয়াজের আমদানি নেই। এখন ভরা মৌসুম। তারপরও এক মাস আগে যে পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকা ছিল, তা এখন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা।
পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্থানীয় পাইকারি বাজার বন্ধ। ঢাকায় পণ্য আসছে কম। এ কারণে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়টি উঠে এসেছে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনেও। সেখানে লকডাউনের মধ্যেও সীমিত আকারে পাইকারি বাজার চালু রাখা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের ট্রাকগুলোর মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করা, বন্দরে জরুরি পণ্য দ্রুত খালাসের ব্যবস্থা করা, আমদানি ছাড়পত্র দেওয়া সংস্থাগুলোর কার্যক্রম চালু রাখা, তদারকি জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও খাদ্যপণ্য আমদানি করে, সেসব দেশের করোনা পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ রূপ নেয়নি। তাই তারা রপ্তানি চালু রেখেছে।
দেশের বাজার চড়া থাকায় তার মূল ভুক্তভোগী হচ্ছে সীমিত আয়ের মানুষ। চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ ও রসুন ছাড়া কোনো সংসারই চলে না। এসব পণ্যের দামই বাড়তি। আগামী সপ্তাহে পবিত্র রমজান মাস শুরু হতে পারে। এখন ক্রেতারা রোজার কেনাকাটা করছেন।
জানতে চাইলে ঢাকার কাজীপাড়ার বাসিন্দা শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। মানুষের আয় কম। এই সময়ে বাজার এত চড়া হলে বাঁচা কঠিন হয়ে যায়। তিনি বলেন, সবাই সরকারের সহায়তা পায় না। আবার হাতও পাততে পারে না।