তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তদারকি ও সমন্বয়ের জন্য একক কর্তৃপক্ষ গঠনসহ ১২ দফা সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) রাজধানীর ধানমন্ডিতে সংস্থাটির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব সুপারিশ করা হয়। ‘তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন : অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সংস্থার সহকারী প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা ও উপ-প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. মোস্তফা কামাল।
প্রতিবেদনের সার্বিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় পরবর্তী ছয় বছরে কারখানার নিরাপত্তা, তদারকি, শ্রমিকের মজুরি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। এ সময়ে মালিক পক্ষ রফতানি বাড়ানো ও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে জোড় দিলেও শ্রমিক অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয়নি।
শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতির রয়েছে উল্লেখ করে টিআইবি বলছে, মালিক পক্ষের প্রভাবে শ্রম আইন যতটা না শ্রমিক স্বার্থে প্রয়োগ হচ্ছে তার চেয়ে বেশি মালিক পক্ষ সুবিধা নিয়ে শ্রমিক অধিকার ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
টিআইবি দাবি, ইপিজেড শ্রম অধ্যাদেশ ২০১৯ জারি হলেও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে এখনও আইনি সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান রয়েছে। এছাড়া শ্রমিকের চাকরিচ্যুত, ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা, দুর্ঘটনার জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, সংগঠন করার অধিকার, অসুস্থতার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ইত্যাদি বিষয়ে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। পোশাক খাতে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে মালিক, সরকার ও শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় কাউন্সিল কার্যকর ভূমিকা রাখছে না।
টিআইবির অভিযোগ, মজুরি বাড়ানোর বিষয়ে কথা বললে ছাঁটাই ও মামলার মাধ্যমে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তৈরি পোশাক খাতে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করা হলেও সম্পূরক শিল্পে নীতি-সুবিধার ঘাটতি রয়েছে, যা এ খাতের টেকসই উন্নয়নে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। এছাড়া সার্বিকভাবে আইন প্রয়োগে দীর্ঘসূত্রতার কারণে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি, শ্রমিক অধিকার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বলে টিআইবির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়।
এসব পর্যবেক্ষণ বিবেচনায় পোশাক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় টিআইবি ১২ দফা সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো-
১. তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তদারকি ও সমন্বয়ে একক কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে।
২. শ্রম আইন এবং ইপিজেড শ্রম অধ্যাদেশে ঘাটতি সংশোধন করতে হবে।
৩. দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল গঠন করে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে।
৪. শ্রম অধিদফতরের সক্ষমতা বাড়ানো ও সেবা নিশ্চিত করা।
৫. শ্রমিকদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মামলা প্রত্যাহার ও চাকরিচ্যুতদের কাজে পুনর্বহালের ব্যবস্থা।
৬. শ্রমিকদের আইনগত অধিকার সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
৭. সাব-কনট্রাক্ট ও ক্ষুদ্র কারখানায় কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে একটি তহবিল গঠন করতে হবে।
৮. সকল বায়ারকে তাদের ওয়েবসাইটে নিজ নিজ বাংলাদেশি ব্যবসায়িক অংশীদার কারখানার নাম প্রকাশ করতে হবে এবং কারখানা বন্ধ করা শ্রমিক চাকরিচ্যুতিতে ক্ষতিপূরণ না দেয়া ও পণ্যের মূল্য নির্ধারণ না করাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক আচরণ বন্ধ করতে হবে।
৯. কেন্দ্রীয় কল্যাণ তহবিল হতে গ্রুপ বীমার প্রিমিয়াম দেয়ার বিধান রহিত করতে হবে।
১০. ত্রিপক্ষী কাউন্সিল কার্যকর করা।
১১. তৈরি পোশাক খাতের প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা বাড়াতে হবে।
১২. রেডিমিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল কার্যকর করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে টিআইবি জানায়, ২০১৩ সালের ঘোষিত মজুরি অনুযায়ী প্রথম গ্রেডে ছিল ৮ হাজার ৫০০ টাকা। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি ঘোষিত প্রথম গ্রেডে নতুন মজুরি করা হয়েছে ১০ হাজার ৯৩৮ টাকা। কিন্তু ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টসহ ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে মজুরি হওয়ার কথা ছিল ১৩ হাজার ৩৪৩ টাকা। সেই হিসেবে মজুরি ২ হাজার ৪০৫ টাকা বা ২৮ শতাংশ কমেছে। এভাবে নতুন কাঠামোতে প্রত্যেক গ্রেডে মজুরি কমেছে। আর সার্বিকভাবে হিসাব করলে কমেছে ২৬ শতাংশ। মজুরি বৈষম্য নিয়ে আন্দোলন করায় ৫ হাজার শ্রমিককে আসামি করে ৩৫টি মামলা করা হয়েছে। ১৬৮টি কারখনায় ১০ হাজার শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পোশাক খাতে অনেক অগ্রগতি হলেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘাটতি রয়ে গেছে। শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি পর্যাপ্ত দৃষ্টি পাচ্ছে না। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেছে। বাস্তবে মজুরি কমে গেছে বলে ধারণা করা হতো। আমাদের প্রতিবেদনেও তা ওঠে এসেছে। আগের তুলনায় ২৬ শতাংশ মজুরি কমে গেছে। সেটি তো বাড়েইনি বরং যারা আন্দোলন করেছে তাদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
ট্রেড ইউনিয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে আইনি ও প্রায়োগিক দুর্বলতা রয়েছে। মাত্র ৩ শতাংশ কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে। যার অধিকাংশই মালিকদের দ্বারা প্রভাবিত।