[ রাতের গল্প থেমে যাওয়ার পড়ে ঘুমঢুলু চোখে আরও উজ্জ্বল মনে হয় সুখ তারার রঙ। তেমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম ‘আরজ আলী মাতুব্বর’। তার কর্মময় বর্ণালি জীবন পাঠে সকলকেই আকৃষ্ট করে। রত্নগর্ভা বরিশালের মাটি যে কেউ অহংকার করে বুক পকেটে চেপে রেখে যদি বলেন – আমি সাত রাজার ধন পকেটে ধারন করেছি তাতে মোটেই ভুল হবে না।]
আরজ আলী মাতুব্বরকে নিয়ে কিছু লিখব ভাবতে গিয়ে মনে হল তার বিভিন্ন বিষয়ে অনেক আলোচক আলোচনা করেছেন। কেবল মাত্র জমি জরীপ বিষয়ে তেমন প্রবন্ধ বা আলোচনা দেখছি না। তাই মাতুব্বর সাহেবের সর্ব শেষ পেশাটা নিয়েই লিখতে বসলাম। যেহেতু আমিও একজন আমিন তাই এই বিষয়টি নিয়ে লেখা আমার জন্য সুবিধা হবে বলেই তার জরীপ বিষয়ক দক্ষতাকে তুলে আনার চেষ্টা করছি। কৌশল অবলম্বন করেই জরীপ করতে হয়। তার আগে জানতে হয় জ্যামিতিক নিয়ম।
লেখাপড়া জানলেই দলিল পর্চা পড়া যায় কিন্তু লেখাপড়া জেনে জমি জরীপ করা যায় না। এমন কি জরীপ বিষয়ের ওপর পড়াশুনা করেও এই কাজটি করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না আপনি মাঠ পর্যায় বিজ্ঞ কোনো আমিনের সাথে দীক্ষা নেন। এ কাজে সব চেয়ে বেশী গুরুত্বের বিষয় ধৈর্য ও একাগ্রতা। যার সবটুকুই মাতুব্বর সাহেবের ছিল। এর সাথে আরও প্রয়োজন কিছু গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি। যেমন ডিভাইডার, স্কেল ও শিকল। এরপরে সূত্র অনুসারে পরিমাপ করতে হয়। মাতুব্বর সাহেব ইতিপূর্বে ভূগোল বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করার সুবাদে কিছুটা আগানো ছিল। তিনি ভৌগলিক নিয়মে নক্সার উপরে অঙ্কিত স্কেল পর্যালোচনা করে তদরূপ একটা স্কেল তৈরী করলেন পীজ বোর্ড কাগজ দ্বারা। ডিভাইডার বা কাঁটা তৈরী করলেন টিন দিয়ে! ভাবা যায়! শুধু মাত্র ভূগোলের মানচিত্রে ১ ইঞ্চি সমান ৪০০, ৫০০ মাইল এবং ম্যাপ বা নক্সায় ১৬ ইঞ্চি সমান ১ মাইলকে মাথায় রেখে সরজমিন পরিমাপ করতে চেষ্টা করলেন। যদিও প্রথম চেষ্টা ব্যাহত হল কিন্তু তাতে তিনি বরাবরের ন্যয় অদৈম্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেন।
পরক্ষণে প্রতিবেশী একজন সুদক্ষ আমিন এর কাছ থেকে যত সামান্য ধারনা নিলেন স্কেল সম্পর্কে। ভদ্রলোক তার অব্যবহারিত একটি বিঘা-কাঠার স্কেল দিয়ে দিলেন। সাথে করে পরিমাপের শিকল ধার এনে নিজ হাতে লোহার তার কেটে তাতে নিখুঁত ভাবে কড়ি ও আংটি বসিয়ে একটা অবিকল শিকল বা গান্টর চেইন তৈরী করলেন। এবার শিকল ও স্কেল পেয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী হয়ে জরীপ কাজে মাঠে নেমে পড়েন। বিনা প্রশিক্ষণে স্থানীয় নিয়মে বাংলা ১৩৩৩ সালের শেষ দিকে সরজমিনে জরীপ কাজ শুরু করেন দৈনিক এক টাকা মজুরিতে। ১৩৮১ সালে অর্থাত কাজের শেষ সময় কালে দৈনিক মজুরি ছিল ৮১ টাকা।
তার পরিমাপকৃত অনেক সিমানা পিলার এখনও বলবৎ আছে যা তিনি পরিমাপ করে পূঁতে দিয়ে ছিলেন প্রায় শত বছর আগে। আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে পরিমাপ করলেও তার পোঁতা কোন সিমানা পিলারকে ভুল প্রমান করতে পারিনি। যদিও তিনি পরবর্তী সময়ে আধুনিক পরিমাপ শিখে ছিলেন একজন সার্ভে সুপার ভাইজারে কাছে কিন্তু তাও মাঠ পর্যায় প্রায় বিশ বছর কাজ করার পর। তিনি নিজ হাতে দু’টি ইউনিয়নের নক্সা তৈরী করেছেন বলে তার লেখায় উল্লেখ রয়েছে। বাংলা ১৩৬৯ সালে চরমোনাই ইউনিয়ন অন্যটা ১৩৭৪ সালে চরবাড়ীয়া ইউনিয়ন।
আরজ আলী মাতুব্বর মানুষ হিসেবে অত্যান্ত সরল ছিলেন যা আমরা জান্তে পারি তার রচনা সমগ্র থেকে এবং তার দু’একজন সহচর থেকে। তিনি জীবদ্দশায় সমস্ত বিষয় লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন বলেই খুব সহজে বেড়িয়ে আসে একটা জীবনের তরতাজা ইতিহাস। দীনতা পিষে কিভাবে সমাজ ও জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় তা আরজ আলী মাতুব্বর পাঠে সরল হয়ে আসে।
তথ্য : আরজ আলী মাতুব্বর সমগ্র-
লেখক শফিক আমিন