সিরিজঃ প্রশ্নবোধক সিরিজ
এপিসোডঃ দেশ
নির্মাতাঃ শুভ্র শিশির ও নাহিদ হাসান
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠাঃ আমাদের সিনেমা
ব্যাপ্তিঃ ৪.৩২ সেকেন্ড
গণমাধ্যম এক অদ্ভুত প্রতিবাদী হাতিয়ার; এক প্রেরণাদায়ী মন্ত্র। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ এর ভূমিকা আমরা সবাই জানি। এই মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগে বেতার এখন আমাদের কাছে অচেনা। টেলিভিশনকে ও ছাড়িয়ে আমাদের সামনে এখন বিশাল মুক্ত আকাশের মতন দাঁড়িয়ে ইউটিউব। নেতিবাচক অনেক দিক যে এর আছে সেগুলো অস্বীকার করার কোন যৌক্তিক কারণ আমার কাছে নেই। তবে ইতিবাচক দিক ও নেহাত কম নয়। ব্যবহার করতে জানতে হয়! আমাদের সিনেমা নিবেদিত শুভ্র শিশির ও নাহিদ হাসান এর ‘প্রশ্নবোধক সিরিজ’ এর প্রথম এপিসোড- ‘দেশ’ এই ইউটিউবের বদৌলতেই দেখা। নামেই বোঝা যাচ্ছে আরো এপিসোড হবে। লেখার শুরুতেই গণমাধ্যম এর যে বন্দনা শুরু করেছিলাম সেটাকে এখন অভিনয় শিল্পে নিয়ে এসে আরো অনেক কিছু বলা যাবে। একটি ভালো চলচ্চিত্রকে অসংখ্য আঙ্গিকে আলোচনা করা যায়। একেক জন এর কাছে এটা ধরা দেয় এক এক রকম করে। এটা এর এক ধরণের সফলতাও বলে আমার মনে হয়। আমার দর্শনপোলব্ধি হয়ত পরিচালকদ্বয়ের মূল প্রেরণার সাথে না ও মিলতে পারে কিন্তু মাত্র ৪.৩২ সেকেন্ড ব্যাপ্তির এই ছোট্ট চলচ্চিত্রের ভাষায় আমি দেখতে পেলাম এদেশের লাখো কর্মসন্ধানী তরুণের হাহাকার। এই ছোট্ট চলচ্চিত্রটির বার্তা দ্বারা আমি এতোটাই আন্দোলিত হয়েছি যে এর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমি বলার অবকাশ পাচ্ছি না। গত ১৭ মার্চ জাতীসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক স্বীকৃতি দিয়েছে। তলাবিহীন ঝুঁড়ি’র ব্যঙ্গোক্তি পায়ে দলে ‘ভিশন-২০২১’ কে সামনে রেখে দুর্বার গতিতে উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় স্বদেশ। উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাবার তিনটি পূর্ব শর্ত ই আমরা পূরণে সফল হয়েছি; অনেক এগিয়ে গিয়েছি মানব উন্নয়ন সূচকেও। কিন্তু এতো সবের মধ্যেও দীর্ঘসময় পরে শিক্ষাজীবন শেষ করা একজন যুবক কি জানে তার ভবিষ্যৎ? একজন দিন আনা দিন খাওয়া রিক্সাওয়ালা কি বিশ্বাস করে সে আদালতে গিয়ে সুবিচার পাবে? একজন মেধাবী-দক্ষ শিক্ষার্থী সব ধরণের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কি তার দিনমজুর বাবাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারে যে সে চাকরীটা পাচ্ছেই? একজন অপদস্থ-অত্যাচারের শিকার শিক্ষক কি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে পুলিশ প্রশাসন তাকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দেবে? মূল কাহিনীর হিসাবে মাত্র ২.৩২ সেকেন্ডে এরকম হাজারটা প্রশ্নের উদয় হলো মনে যদিও ৩.৩০ সেকেন্ডের মাথায় পরিচালকদ্বয় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার আক্ষেপের একটি দীর্ঘশ্বাস জড়ানো প্রশ্নবোধকে শেষ করেছেন তাদের নির্মাণ। যে দেশে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ দেশের বাইরে চাকরী করেন সেই দেশটাতেই প্রায় ৮ লক্ষ বিদেশী চাকরী করতে এসে বছরে নিয়ে যায় প্রায় ৩২,০০০ কোটি টাকা। প্রতি বছর প্রায় ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকা এদেশ থেকে নিষিদ্ধ পথে পাচার হয়ে যায় বিদেশে। আর সেই দেশেই প্রতিবছর প্রায় ২২ লক্ষ কর্মক্ষম যুবক চাকরীর বাজারে প্রবেশ করছে। এই বিশাল সংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ চাকরী পাবে অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ বেকারের তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন। এরা কি করবেন? অথচ এই অপার সম্ভাবনাময় যুবশক্তিকে সঠিক পরিচর্যা ও সুযোগ তৈরী করে দিলে আমাদের দেশের এই অগ্রযাত্রা আরো ব্যাপকতায় আরো দ্রুত এগিয়ে যেত। অন্যদিকে ক্রমপ্রসারমাণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি এদেশে আইনের শাসনকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাইতো তো এদেশের মানুষ তাদের পুঁজি ব্যাংকে রাখার সাহস যেমন হারাচ্ছেন তেমনি যুবকরা সরকারী চাকরীর বলয়ে নিরাপদ জীবন পরিচালনার অদ্ভুত স্বপ্নে বিভোর হয়ে ভিন্ন ধারার কিছু করার প্রবণতা অস্বাভাবিক রকমে হারাচ্ছেন। কারণ একটা ব্যবসা বা নতুন উদ্যোগ নিয়ে তা সফলভাবে কোন বাধা ছাড়া পরিচালনা করার পরিবেশ কি সত্যিই এদেশে আছে ? আছে কি কি তথাকথিত নেতাদের চোখে চোখ রেখে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার প্রকৃত সুযোগ? এর উত্তর আমি দিলাম না। শুধু জানিয়ে রাখি এক জরিপে দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলোর ৮২ শতাংশ যুবক ই দেশ ছেড়ে ইউরোপীয় এবং অন্যান্য উন্নত দেশে যাবার মানসিকতা পোষণ করেন। যুব সমাজের এরকম হাজারো বিতৃষ্ণা উঠে এসেছে প্রীতম চৌধুরীর মাত্র একটি কথায়, বিদেশে গিয়ে ঘটিবাটি মাজবো। তবুও এদেশে থাকব না। এ কথার উত্তর দিতে ব্যর্থ হওয়া অয়নের মত হাজার যুবক আকাশে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তবুও স্বপ্ন দেখেন। দেশটাকে আঁকড়ে রেখেই চান পরিবর্তন; চান স্বাধীনতা সনদের সর্বক্ষেত্রে প্রকৃত বাস্তবায়ন। অথচ এই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য, আমাদের একটি মুক্ত-স্বাধীন দেশ দেবার জন্য ৩০ লাখ শহীদ তাদের জীবন উৎস্বর্গ করে গেছেন। এখনো যেসকল বীর মুক্তিযোদ্ধা আমাদের প্রেরণা হয়ে আমাদের মাঝে রয়েছেন তারা এসবে কতটা ক্ষত-বিক্ষত হন সেটা আমরা কেউ ই অনুধাবন করতে পারব না। তাইতো এসব দেখে শাহাবুদ্দিনের মতন বীর মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠে প্রবল আক্ষেপে উচ্চারিত হয় এক রক্তাক্ত প্রশ্নবোধক- দেশটাকে কি এই জন্যই স্বাধীন করছিলাম।
লেখকঃ ছোটন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
শিক্ষার্থী; বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।