আইনি জটিলতায় আটকে গেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ-পদোন্নতি কার্যক্রম। তাই সংকট নিরসনে জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষকদের চলতি দায়িত্বে বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেই কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে প্রায় ২০ হাজার প্রধান শিক্ষক সংকট রয়েছে। এ সংকটের কারণে সহকারী শিক্ষককে ওই পদের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বলে শ্রেণিকক্ষে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান শিক্ষক ছাড়া বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজ সাধারণত সহকারী শিক্ষক চালিয়ে নিচ্ছেন। সহকারী শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিলে কর্মঘণ্টার বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে হয় প্রশাসনিক কাজে। ফলে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ব্যাহত হয়। এর মাশুল দিচ্ছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা।
এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এক বছর আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষকদের চলতি দায়িত্বে পদায়ন করার ঘোষণা দেন। এ প্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের তালিকা পাঠাতে বলা হয়। সেই তালিকার ভিত্তিতে পদোন্নতিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জেলার প্রধান শিক্ষক শূন্য প্রতিষ্ঠানে পদায়ন কার্যক্রম শুরু করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, প্রধান শিক্ষক নেই এমন প্রায় ২০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হযবরল অবস্থা হলেও গত এক বছরে মাত্র ১৫ জেলায় চলতি দায়িত্বে প্রধান শিক্ষক পদে পদায়ন করা হয়েছে। এসব জেলার মধ্যে ২০১৭ সালের ২৩ মে ঢাকা মহানগরে ৮৭ জন, ১২ জুলাই ভোলার ১১৬ জন, ২২ জুলাই লক্ষ্মীপুরে ১১৭ জন, ২৫ অক্টোম্বর মেহেরপুরে ৭৮ জনকে প্রধান শিক্ষক পদে পদায়ন করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ১৮ জানুয়ারি নেত্রকোনায় ৩১৬ জন, ৮ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁওয়ে ২৭৬ জন, ১৩ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় ১৫২ জন, ২৭ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জে ২৬৮ জনকে পদায়ন করা হয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চলতি দায়িত্ব কার্যক্রমে নানা ধরনের অনিয়ম ওঠায় ডিপিই থেকে পদায়নের দায়িত্ব মাঠ পর্যায়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। জ্যেষ্ঠতা নির্বাচনে অনিয়ম করা হয়েছে উল্লেখ করে অনেক শিক্ষক আদালতে মামলাও করেছেন। এরপর চলতি বছরের মার্চে এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে মাঠ পর্যায়ে পদায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই নির্দেশনা মোতাবেক কিশোরগঞ্জে আংশিক ১৯৪ জন, শেরপুরে ১৭০ জন, ময়মনসিংহে ৫৯২ জন, দিনাজপুরে ৫৬৮ জন, মাগুরায় ১২৪ জন, যশোরে ৩৮০ জন এবং গোপালগঞ্জে ১৯১ জনকে চলতি দায়িত্বে প্রধান শিক্ষক পদে বসানো হয়।
ডিপিই থেকে জানা গেছে, বর্তমানে কুমিল্লা, সিরাজগঞ্জ, পঞ্চগড়, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, নোয়াখালী ও কিশোরগঞ্জের চার উপজেলার জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের তালিকা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা ও ফরিদপুরের তালিকা যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। টাঙ্গাইল, সাতক্ষীরা, জয়পুরহাট ও ঝালকাঠির ফাইল চলমান। জামালপুর, মাদারীপুর, বাগেরহাট, বরিশাল, পটুয়াখালী, হবিগঞ্জ, চট্রগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজবাড়ী, নাটোর খাগড়াছড়ি, নীলফামারী ও মুন্সীগঞ্জসহ ১৭ জেলার তালিকা যাচাই-বাছাই চলছে। ঢাকা, গাজীপুর, রংপুর, ঝিনাইদহ, পিরোজপুর, নওগাঁ, রাজশাহী, ঝালকাঠি, বরগুনা, খুলনা, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাটসহ ১২ জেলার গ্রেডেশন তালিকা পাওয়া গেছে। পর্যায়ক্রমে তালিকা তৈরি করা হবে। সিলেট, মৌলভীবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, পাবনা, নড়াইল, কক্সবাজার ও ফেনীসহ আট জেলার তথ্য-উপাত্তে কিছু ভুল পাওয়া গেছে। তা সংশোধনের জন্য জেলায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। এছাড়া আগামী ৩০ মে’র মধ্যে বাকি জেলার জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের তালিকা পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।
ডিপিই’র একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতি সপ্তাহে দুটি করে জেলায় প্রধান শিক্ষক পদে চলতি দায়িত্বে বসানের প্রজ্ঞাপন জারি করার কথা থাকলেও নানা কারণে এ কাজে বিলম্ব হচ্ছে। অধিকাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের পাঠানো তথ্যে নানা ভুল-ভ্রান্তি থাকছে। তা আবারো সেই জেলায় পাঠানো হয়, তারপর তা সংশোধন করে পাঠানো হয়। তারা জানান, এ কার্যক্রমে একটি জেলার ফাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকসহ একাধিক কর্মকর্তার শতাধিক সাক্ষর প্রয়োজন হয়। কেউ ছুটিতে থাকলে ফাইল আর উপরে-নিচে উঠা-নামা করে না। অনেকে আবার দীর্ঘদিন ছুটিতে থাকায় পুরো প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে পড়ে। এরপর তালিকা চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে সেখানেও অনেক সময়ক্ষেপণ হয়। এসব কারণে চলতি দায়িত্বে পদায়নের কাজে স্থবির অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, আইনি জটিলতায় ২০১১ সাল থেকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রধান শিক্ষক পদ দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ায় বিধি মোতাবেক নিয়োগ ও পদোন্নতি সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীনে চলে যায়। নিয়ম অনুযায়ী, এ পদে ৩৫ শতাংশ সরাসরি নিয়োগ ও ৬৫ শতাংশ জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দেয়ার কথা থাকলেও নিয়োগ বিধি না থাকায় ২০১১ সাল থেকে পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। সারা দেশের ৬৪ হাজার সরকারি বিদ্যালয়ের মধ্যে ২০ হাজারই চলছে প্রধান শিক্ষক ছাড়া। সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব হলেও আইনি জটিলতার কারণে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছে না মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে প্রতি বছর পিএসসি আয়োজিত বিসিএস পরীক্ষার নন-ক্যাডার থেকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। শুধু তাই নয়, যাদের সুপারিশ করা হচ্ছে তাদের অনেকে অন্য দফতর, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করায় তাদেরও পাওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এফ এম মনজুর কাদির বলেন, প্রধান শিক্ষকের পদ দ্বিতীয় শ্রেণি হওয়ায় বিধি মোতাবেক পিএসসি’র মাধ্যমে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। ফলে এ প্রক্রিয়ায় নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, পিএসসি’র একটি বিসিএস প্রক্রিয়া শেষ করতে দুই বছর পার হচ্ছে। সেখান থেকে নন-ক্যাডারে কিছু সুপারিশ আসলেও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এ প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীকরণ করে নিয়োগ দেয়া জরুরি। বর্তমানে পদোন্নতি প্রাপ্তদের চলতি দায়িত্ব প্রধান শিক্ষক পদে বসিয়ে এ সমস্যা দূরীকরণের চেষ্টা চলছে। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগে জাতীয়ভাবে একটি কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি কাজের জন্য একটি নির্ধারিত পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। চলতি দায়িত্ব দেয়ার ক্ষেত্রেও তা করতে হচ্ছে। তবে এ প্রক্রিয়া আরও সহজ করা প্রয়োজন। ডিপিই থেকে তালিকা পাঠানোর পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে তা চূড়ান্ত করা হয় বলে জানান এ অতিরিক্ত সচিব।