উত্তরের জেলা লালমনিরহাট। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাদক পাচার রুট বলে পরিচিত। লালমনিরহাট-১ (হাতীবান্ধা-পাটগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেনের ভাতিজা মীর সাব্বির হোসেনকে জেলার মাদক সম্রাট নামে জানে এলাকায়। বেশ কয়েকবার আটক হয়েছিলেন মাদক চোরাচালানের দায়ে। এমনকি মোতাহার হোসেন নিজেও ভাতিজাকে পুলিশে দিয়েছিলেন।
মাদকের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্য মোতাহারেরও শক্ত অবস্থান। কিন্তু আইনের ফাঁকে প্রতিবারই বের হয়ে এসেছেন ভাতিজা। অভিযোগ রয়েছে পুলিশকে ম্যানেজ করেই সাব্বিরের এই অপকর্ম। সাব্বিরের মাদক সাম্রাজ্যের সহায়ক ছিলেন হাতীবান্ধা থানার এক সাব ইন্সপেক্টর, এমনটিই প্রচার রয়েছে জনমুখে। সর্বশেষ নীলফামারীর জলঢাকায় গাড়িতে ফেনসিডিল বহনের দায়ে সাব্বিরকে আটক করে পুলিশ। এখন সাব্বিরের মাদক নেটওয়ার্ক ভেঙে তছনছ।
সাব্বিরের মতো গড়ে তোলা মাদকের শত শত নেটওয়ার্ক ভেঙে দিয়েছে লালমনিরহাট পুলিশ। মাদক চোরাচালান এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশের যোগসাজশের অভিযোগ ছিল দুই বছর আগেও। অথচ সেই পুলিশই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে লালমনিরহাটে।
বিশাল সীমানা নিয়ে দরিদ্র মানুষের ঠিকানা লালমনিরহাট জেলা। কৃষি আর দৈনিক মজুরির ওপরেই বেঁচে থাকা এখানকার অধিকাংশ মানুষের। দিন আনে দিন খায় গোছের মানুষের জীবনে শান্তিও ছিল অফুরন্ত। অথচ গেল এক দশকে সে শান্তি যেন উবে গেছে। মাদকের সর্বনাশা থাবায় সমস্ত সুখ কেড়ে নিয়েছে এখানকার মানুষের। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, গরিব সবাই যেন এখন মাদক আতঙ্কে। হাত বাড়ালেই মিলত মাদক। ফেনসিডিল আর গাঁজা সেবন চলত স্কুল-কলেজের বারান্দাতেও। গোটা লালমনিরহাট জুড়েই মাদকের এই ছোবল। সভা-সেমিনার করেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। বরং দিনকে দিন এর ভয়াবহতা বাড়তেই থাকে। অপ্রাপ্ত বয়সীরাও মাদক সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। দিশেহারা হয়ে পড়ে এখানকার অভিভাবকরা।
মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে কথা হয় ব্যবসায়ী ও দোয়ানি হাইস্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আনোয়ার মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি বলেন, মাদক নিয়ে সবাই আতঙ্কে। কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছিল না এখানকার মানুষ। মাদকের কারণে অন্য অপরাধের মাত্রাও বেড়ে যায় গত কয়েক বছরে। চুরি-ছিনতাই তো আছেই, স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও গাঁজা-ফেনসিডিল সেবন করে আসছে।
চলমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সময় বদলেছে। মাদকের বিরুদ্ধে এখন সবাই সোচ্চার। তবে পুলিশের ইতিবাচক ভূমিকার কারণে মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য অনেকটাই কমেছে। বিশেষ করে বর্তমান পুলিশ সুপার আসার পরেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পুলিশ চাইলে মাদক নিয়ন্ত্রণে শতভাগ সফল হতে পারবে।’
বছর দেড়েক আগেও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাদকদ্রব্য পাচার রুট হিসেবে পরিচিত ছিল এ জেলার। পুলিশের নিয়মিত অভিযানে সে পরিচয় বদলে গেছে। লালমনিরহাটের চিত্র এখন পুরোটাই ভিন্ন। মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকেই এলাকা ছেড়েছে। কেউ মন দিয়েছেন কৃষি বা অন্য ব্যবসায়। পুলিশের অভিযানেই স্বস্তি ফিরেছে জনমনে। মাদকের এক সময়ের আখড়া মোগলহাটের নামও পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে গোল্ডেন ভিলেজ।
স্থানীয়রা এর পুরো কৃতিত্ব দিলেন জেলা পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হককে। এমন অবদানের জন্য রংপুর রেঞ্জের শ্রেষ্ঠ পুলিশ সুপার উপাধিও পেয়েছেন তিনি। মাদককের বিরুদ্ধে পুলিশের এই কঠোর অবস্থান ভবিষ্যতেও ধরে রাখার দাবি সীমান্তবর্তী লালমনিরহাটবাসীর।
লালমনিরহাট পুলিশ প্রশাসন জানায়, ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে গাঁজা ৩৯৭৮.২৭০ কেজি, ফেনসিডিল- ৩২০৯৩ বোতল, হেরোইন ১৯৩৮০ পুরিয়া, ইয়াবা ১৬ হাজার ৮৫৯ পিস, বিদেশি মদ ৫৫০ বোতল, দেশি মদ ১৮ বোতল, অ্যালকোহল ১২ বোতল, কোরেক্স ২২৩ বোতল, চোলাই মদ ১৬৫.৫০০ লিটার, ফেলিরেক্স ৬ বোতলসহ মোট ৭ কোটি ১৯ লাখ ৫১ হাজার ৬৪০ টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়।
মাদক প্রসঙ্গে কথা হয় হাতীবান্ধা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওমর ফারুকের সঙ্গে। বলেন, মাদক একটি সামাজিক ব্যাধি। সীমান্ত হওয়ার কারণে লালমনিরহাটে মাদকের ঝুঁকি আরও বেশি। দেশের অন্যত্র থেকে মাদকব্যবসায়ী লালমনিরহাটের বিভিন্ন পয়েন্ট ব্যবহার করে আসছে। বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে অন্তত তাই জানতে পেরেছি।
তিনি বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এখন বদ্ধপরিকর। লালমনিরহাট পুলিশ সুপার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কোনো ছাড় হবে না মাদকের সঙ্গে জড়িতদের। পুলিশ প্রশাসন জড়িত থাকলেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আর এ কারণেই পুলিশের ওপর জনআস্থা বাড়ছে। সাধারণও পুলিশকে এখন এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে। এলাকা মাদকমুক্ত রাখতে পুলিশের চেষ্টার কোনো অন্ত থাকবে না।’
মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ায় ইতোমধ্যে স্বীকৃতিও মিলেছে লালমনিরহাট পুলিশের। মাদক নির্মূলে বিশেষ অবদানের জন্য টানা দ্বিতীয়বার দেশ সেরা হয়েছে লালমনিরহাট জেলা পুলিশ।
মাদক নির্মূলে ‘গ গ্রুপে’ দেশ সেরা এবং চোরাচালানে ‘গ গ্রুপে’ দ্বিতীয় নির্বাচিত হয়ে গত ১০ জানুয়ারি পৃথক দুটি ক্রেস্ট ও সনদ গ্রহণ করেন লালমনিরহাট জেলা পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হক।
পুলিশ সপ্তাহের সমাপনী অনুষ্ঠানে ক্রেস্ট ও সনদ দুটি হস্তান্তর করেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক। গত বছরও চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য নির্মূলে বিশেষ অবদান রাখায় লালমনিরহাট জেলা পুলিশ ‘গ গ্রুপে’ দেশ সেরার ক্রেস্ট ও সনদ পায়।
ভারতীয় সীমান্তবর্তী এ জেলার মাদক নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন এসএম রশিদুল হক।
এরপর থেকে একের পর এক অভিযানে ও জেলায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের তৎপরতায় প্রতিনিয়ত মাদকসহ ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে পুলিশ।
একপর্যায়ে পুলিশি তৎপরতায় দেড় সহস্রাধিক মাদক ব্যবসায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে মাদক ছেড়ে দিয়ে নতুন জীবনযাপনের শপথ নেন। শুধু অভিযানেই সীমাবদ্ধ নেই এ জেলার পুলিশ। মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদসহ সামাজিক বিভিন্ন অপরাধ নির্মূলে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষার্থী ও পাড়া-মহল্লায় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সভা সেমিনারও করেছেন লালমনিরহাট পুলিশ সুপার।
এতে করে ২০১৭ সালে মাদকের সঙ্গে চোরাচালান রোধে ‘গ গ্রুপে’ দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে লালমনিরহাট জেলা পুলিশ। শুধু তাই নয়, গত দেড় বছরে রংপুর রেঞ্জের সেরা পুলিশ সুপার হিসেবে ৬টি ক্রেস্ট অর্জন করেন লালমনিরহাট পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হক।
মাদকবিরোধী অভিযান প্রসঙ্গে কথা হয় এসএম রশিদুল হকের সঙ্গে। বলেন, মাদকবিরোধী সচেতনতা বাড়াতে আমরা দুইভাবে কাজ করছি। প্রথমত, পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সভা-সেমিনার, লিফলেট বিতরণ, স্থানীয় ক্যাবল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা নেয়া। আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমেও সচেতনতা বাড়ানো যায়। একজন অপরাধীর বিরুদ্ধে সঠিক ব্যবস্থা নিলে আর দশজন সচেতন হয়ে যায়। আমরা এটি খুব শক্ত হাতে করছি। মাদকের বিরুদ্ধে লালমনিরহাট পুলিশ একাট্টা।
তিনি বলেন, একার পক্ষে কোনোকিছুই করা সম্ভব হয় না। আমি যোগদানের পরেই মাদকের ব্যাপারে বার্তা পৌঁছে দিয়েছি পুলিশের প্রতিটি সদস্যের কাছে। কনস্টেবল থেকে শুরু করে একেবারে ঊর্ধ্বতন অফিসাররাও এ ব্যাপারে একাট্টা এখন।