করোনার কারণে আকাশপথে উড়োজাহাজের ফ্লাইট চলাচল অনেক দিন ধরে বন্ধ। তবে করোনাকে প্রতিরোধ করে ফ্লাইট চালুর প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে বিভিন্ন দেশ। ফ্লাইট চালু হলেও কঠোর বিধিবিধান মানতে হবে যাত্রী, বিমান সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে। তবে ফ্লাইটে ওঠার আগে কোনো যাত্রীর গায়ের তাপমাত্রা ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা এর বেশি থাকলে তাঁর যাত্রা বাতিল।
গত রোববার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক সার্কুলারে এ কথা জানানো হয়েছে। সার্কুলারে ভবিষ্যতে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করে নিরাপদে বিমান চলাচল করতে যাত্রী, বিমানবন্দর, বিমান সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের ৩৫টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিমান ভাড়া বাড়তে পারে। আবার ভাড়া বাড়লে যাত্রীও হারাতে হতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নির্দেশনা অনুযায়ী করোনাভাইরাসসহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়িয়ে ভবিষ্যতে বিমান চলাচলের জন্য এই গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। এ কথা জানিয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিমানযাত্রীদের এই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। একইভাবে বিমান সংস্থা, বিমানবন্দরসহ সবাইকে এটি মানতে হবে।
বিমানবন্দরে টার্মিনালে একাধিক ফ্লাইটের যাত্রীরা একসঙ্গে থাকতে পরবেন না। প্রতিটি ফ্লাইটে ওঠার আগে যাত্রীদের বোর্ডিং পাস নেওয়ার পর নির্ধারিত এলাকার মধ্যে থাকতে হবে। সবাইকে মাস্ক ও গ্লাভস পরতে হবে। বিমানবন্দরে আসার আগে এগুলো পরে আসতে হবে। টার্মিনালে ঢোকার পর যাত্রীরা যে বিমানে করে যাবেন, তাঁরাই নতুন গ্লাভস, মাস্ক দেবেন। নতুন মাস্ক ও গ্লাভস পরে ফ্লাইটে ওঠার সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে। বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হবে।
বেবিচকের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রত্যেক যাত্রীকে স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি ফরম পূরণ করতে দেওয়া হবে। এই ফরমে যাত্রীর নাম, বয়স, লিঙ্গ, জন্মতারিখ, বর্তমান ঠিকানা, এয়ারলাইনসের নাম, ফ্লাইট নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, শরীরের তাপমাত্রা, মোবাইল ও ই-মেইল নম্বর পূরণ করতে হবে। একই সঙ্গে ফরমে তিনটি প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ অথবা না টিক দিয়ে উত্তর দিতে হবে। এক নম্বর প্রশ্নে থাকতে, ’আপনার (যাত্রী) কি জ্বর বা কফ হচ্ছে?’ দ্বিতীয় প্রশ্নে থাকবে, আপনার কি জ্বর এবং শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? এবং তৃতীয় প্রশ্নে থাকবে, গত ১৪ দিনে কোভিড-১৯ বা এই রোগের কোনো উপসর্গ থাকার কারণে আপনাকে কোনো বিমানবন্দরে বোর্ডিং থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে কি না।
এ তিনটি প্রশ্নের যেকোনো একটির উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে যেকোনো যাত্রীকে আর ফ্লাইটে উঠতে দেওয়া হবে না। স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী ওই যাত্রীকে পরবর্তী চিকিৎসা নিতে হবে। তবে এ তিনটি প্রশ্নের উত্তর ‘না’ হলেও যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা মাপা হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হলে তাকে আর ফ্লাইটে উঠতে দেওয়া হবে না।
বেবিচক চেয়ারম্যান জানান, চেক-ইনের সময় কাউন্টার ও আশপাশের সহযোগীদের সার্বক্ষণিক মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, ডিস্পোজেবল ক্যাপ পরতে হবে। প্রতিটি কাউন্টারের পাশে হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনে যাত্রীকে চেক-ইনের লাইনে দাঁড়াতে হবে। প্রতি ফ্লাইটের আগে ডিসইনফেকট্যান্ট ছিটিয়ে ফ্লাইট জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এরপর যাত্রীকে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিতে হবে।
বেবিচকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, দেড় ঘণ্টার নিচে কোনো ফ্লাইটে পানি ছাড়া খাবার দেওয়া যাবে না। তবে ডায়াবেটিসের রোগীদের সীমিত আকারে পানি ও জুস দেওয়া হবে। এই নির্দেশনা কার্যকর হলে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটে যাত্রীদের হালকা খাবার পরিবেশন বন্ধ হয়ে যাবে। একই সঙ্গে বড় উড়োজাহাজের ধারণক্ষমতার সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ এবং ছোট উড়োজাহাজের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ যাত্রী প্রতিটি ফ্লাইট থাকবে। এর বেশি যাত্রী নেওয়া যাবে না।
সার্জিক্যাল মাস্ক অথবা মানসম্মত মাস্ক, ক্যাপ প্রতিটি ফ্লাইটের ক্রুদের পরা বাধ্যতামূলক। কেবিন ক্রুদের এন-৯৫ মাস্ক, চশমা, রাবারের হ্যান্ড গ্লাভস ও ফেসিয়াল মাস্ক পরতে হবে। হ্যান্ড গ্লাভস ও মাস্ক প্রতি চার ঘণ্টায় বদলাতে হবে। তাদের ককপিটে প্রবেশ যত সম্ভব কমিয়ে ইন্টারকমে যোগাযোগ করতে হবে। ফ্লাইটে দুজন কেবিন ক্রু একসঙ্গে খাবার পরিবেশন করতে পারবেন না। কেবিন ক্রুরা যাত্রাবিরতিতে কোনো হোটেলে অবস্থান করলে সেখানকার রুমেই খাবার খেতে হবে। প্রয়োজনে ওই হোটেলের ভেতরের রেস্টুরেন্টে খাবার খাবেন। হোটেলের বাইরে যেতে পারবেন না। ফ্লাইটের দুই সারিতে আসন খালি রাখতে হবে। ফ্লাইটে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে রোগী পাওয়া গেলে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ওই সব আসনে কেবিন ক্ররা বসাবেন। সবশেষে ক্রু ও পাইলটদের মানসিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে।
বেবিচকের নির্দেশনায় আরও উল্লেখ করা হয়, প্রতিটি বিমানবন্দরে ও প্রতিটি উড়োজাহাজ ছাড়ার আগে স্যানিটাইজার ছিটিয়ে জীবাণুমুক্ত করে রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে বেবিচক চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সার্টিফিকেট অব ডিসইনফেকশন’ ফ্লাইট ছাড়ার আগে নিতে হবে। বেবিচকের প্রতিনিধিরা এই প্রক্রিয়াটি দেখে সার্টিফাই করলেই ফ্লাইটটি ছাড়বে। তাছাড়া রানওয়েতে উড়োজাহাজগুলো নির্দিষ্ট দুরত্ব মেনে অবস্থান করবে।
বেবিচকের এই নির্দেশনা মেনে চলতে হলে বিমান ভাড়া বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁদের মতে, জীবাণুমুক্ত করার জন্য লোকবল প্রয়োজন হবে। বিমানবন্দরে বাড়তি সময়ও প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু যাত্রীসংখ্যা কমিয়ে ফ্লাইট চালাতে হবে। এতে খরচ বাড়বে, কিন্তু আয় কমবে। ইউএস–বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি ফ্লাইটে যাত্রী কম থাকবে, কিন্তু জীবাণুমুক্তসহ অন্যান্য কার্যক্রমের পেছনে ব্যয় বাড়বে। তাই বিমানভাড়া বাড়তে পারে।
তবে ভাড়া বাড়ানো হলেও সমাধান সহজে মিলবে না বলে মনে করেন অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম। তিনি বলেন, শ্রমিকেরা বিদেশ থেকে ফিরে আসছেন। অথচ আমাদের বিমানযাত্রীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ হচ্ছেন শ্রমিক। করোনার কারণে অনেক শ্রমিকও ছুটিতে আপাতত দেশে ফিরবেন না। এ ছাড়া মানুষের মধ্যে বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ হয়ে গেছে। ভিসা দেওয়াও বন্ধ রয়েছে। এখন ফ্লাইট চালু হলেও ব্যবসায়ী বা অতিজরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিমানে চড়বেন না। তাই ভাড়া বাড়ালেই সমাধান মিলবে কি না, সেটি ভাবনার বিষয়।