১০ বছর কারাবাসের পর বাদল ফরাজি নামের এক নিরপরাধ ব্যক্তিকে ভারতের কারাগার থেকে বাংলাদেশে ফেরত আনতে ভারত সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে সরকার। বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় ওই ব্যক্তিকে দ্রুত ফেরত আনতে বুধবার এ চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি খুনের মামলার আসামির সঙ্গে নামের মিল থাকার কারণে ২০০৮ সালে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢোকার সময় বাদল ফরাজিকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। পর্যটক ভিসা নিয়ে বাংলাদেশের বাগেরহাট থেকে তাজমহল দেখতে বেরিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এরপর আর ফেরেননি। পাসপোর্ট অনুযায়ী বাদলের স্থায়ী ঠিকানা বাগেরহাট এবং বর্তমান ঠিকানা খুলনায়। বাগেরহাটের আবদুল খালেক ফরাজি ও সারাফালি বেগমের ছেলে তিনি।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘বন্দী বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী বাদলকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমরা চিঠি দিয়েছি। এ জন্য নির্ধারিত ফরম পূরণ করে আবেদন পাঠানো হয়েছে। আশা করি, দ্রুত বাদলকে ফিরিয়ে আনা হবে।’
সরকারি নথিপত্রে অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ৬ মে নয়াদিল্লির অমর কলোনির এক বৃদ্ধা খুনের মামলায় বাদল সিং নামে একজন আসামিকে ভারতের পুলিশ খুঁজছিল। ওই বছর ১৩ জুলাই বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় বিএসএফ ভুল করে বাদল ফারাজিকে গ্রেপ্তার করে। ইংরেজি বা হিন্দি জানা না থাকায় তিনি বিএসএফের সদস্যদের নিজের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি। ঠিকমতো বলে বোঝাতে পারেননি তিনি ওই বাদল নন।
ভারতের বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, ভারতের নিম্ন আদালতের রায়ে খুনের অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ নম্বর ধারায় ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট বাদলকে দোষী সাব্যস্ত করেন দিল্লির সাকেট আদালত। বাদলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টেও একই সাজা বহাল থাকে। বাদলের বিষয়ে জানার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সুরক্ষা বিভাগে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এরপর আইন মন্ত্রণালয়, পুলিশের বিশেষ শাখা এবং কারা অধিদপ্তর থেকে মতামত চাওয়া হয়।
আইন মন্ত্রণালয় জানায়, ভারত ও বাংলাদেশের প্যানাল কোড ১৮৬০ অনুযায়ী খুনের সাজায় একই ধরনের বিধান রয়েছে এবং একই ধরনের জেল কোড ব্যবহার করা হয়। তাই বন্দী বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে ফিরে আসার পর একই রকম সাজার আওতায় কারাগারে থাকতে পারবেন। এরপর সুরক্ষা সেবা বিভাগ বাদলের বিষয়ে সমস্ত তথ্য–উপাত্ত যাচাই করে। গত ১৯ এপ্রিল পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে জানানো হয়, বাদল বা তাঁর পরিবারের বিষয়ে কোনো বিরূপ তথ্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে বাদলের নির্দোষ হওয়ার বিষয়টি জানার পর গত ১৯ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক জরুরি বৈঠক করে বাদলকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সভায় বলা হয় বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় দ্রুত বাদলকে ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ। এমন একজন নিরপরাধ ব্যক্তি এভাবে ভারতে কারাগারে থাকতে পারেন না। ওই সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করা হয়। এই কমিটি বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় বাদলকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ভারতের কর্তৃপক্ষকে আবেদনপত্র চূড়ান্ত করবে।
ভারতে হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী গত ১৭ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রসচিবকে এক ফ্যাক্স বার্তায় জানান, অনেক দিন ধরে বাদল ফরাজিকে বাংলাদেশে ফেরানোর বিষয়টি ঝুলে আছে। তাই এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পরে গত ২২ এপ্রিল ভারতে আনুষ্ঠানিক আবেদন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, হাইকমিশনের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়েছে, ভাষাগত সমস্যার কারণে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ার অন্তরীণ থাকা অবস্থায় তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান। তাঁর আচার–ব্যবহারে কারা কর্তৃপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করে সাজার মেয়াদ কমাতে কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করে। বাদল কারাগারে থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কারাগার চত্বরের ইন্দিরা গান্ধী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছেন। স্নাতকের বাইরেও আটটি ডিপ্লোমা কোর্স করেছেন। এখন ইংরেজি ও হিন্দিতে অনর্গল কথা বলতে পারেন।
বাদলের বোন তাসলিমা বেগম বলেন, ‘আমরা অপেক্ষায় আছি ভাইয়ের দেশে ফেরার।’