তিনি মিডিয়াকর্মীদের হাতের নাগালে ধরা দেন না পারত পক্ষে। প্রেস কনফারেন্স থেকে কয়েকশগজ দূর দিয়ে তিনি চলে যান মার্সিডিজ বেঞ্জে করে। কিন্তু ম্যাচসেরা হলে যে সাংবাদিকদের সামনে আসতেই হবে। এটা নিয়ম। তাই তিনি এলেন। সাংবাদিকদের সামনে মুখ খুললেন। লিওনেল মেসির মুখে হাসি দেখে স্বস্তি ফিরল আর্জেন্টাইনদের মধ্যেও। গত দুই ম্যাচে মলিন মুখে মাঠ ছাড়া মেসি সেদিন অনেকটা সময় ব্যয় করলেন জয়ের উৎসবে।
এ ম্যাচ দিয়ে সত্যিকার অর্থে বিশ্বকাপ শুরু হলো আর্জেন্টিনার। মেসিরও। প্রথমার্ধে দুর্দান্ত এক গোল করেছেন; আরেক ফ্রি-কিকে বল লেগেছে বারে। আরও কয়েক পাস দিয়েছেন। বিরতির সময় মাঠে নামার ঠিক আগ মুহূর্তে টানেলে সতীর্থদের শেষ উজ্জীবনী কথাও বলেছেন অধিনায়ক। কোচ নন।
আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচের অর্ধেক সময় শেষ। দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হবে। টানেলে দাঁড়িয়ে সতীর্থদের উদ্দেশ্যে একটা ছোটখাটো বক্তব্য দিলেন লিওনেল মেসি। কী বলেছিলেন তিনি! ‘রোহো, তুমি উপরে উঠে আক্রমণে আসবে। মাসকারেনো, তুমিও উপরে উঠে যাবে। ভয়ঙ্কর আক্রমণ করবে। যাই ঘটুক, আক্রমণের চিন্তা থেকে কখনোই সরে যাবে না।’ মেসির এই একটা বক্তব্যই গোটা দলকে বদলে দিয়েছিল। আক্রমণের চিন্তাটা কখনোই বাদ দেননি আর্জেন্টাইন ফুটবলাররা। রোহো-মাসকারেনোরা ডিফেন্স লাইন ছেড়ে বার বারই বেরিয়ে আসছিলেন। যোগ দিচ্ছিলেন মেসিদের সঙ্গে।
রোহো ম্যাচ শেষে বলেছেন, ‘মেসির মতো অধিনায়ক কেউ নয়। সে বিশ্বসেরা ফুটবলারই কেবল নয়, অধিনায়কও। তার বক্তব্যই আমাকে গোল করতে উৎসাহিত করেছে।’ রোহো গোল করার পর মেসি যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, তা ছিল সত্যিই ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখার মতো।
নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ জিতে মেসি বললেন, ‘ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ আমরা। তিনি আমাদেরকে কখনোই ভুলে যাননি।’ মেসির এই ঈশ্বর প্রীতির কথাও কী খুব বেশি মানুষের জানা ছিল! লিওনেল মেসি অবশ্য আরও একটা কথা খুব জোর দিয়ে বলেছেন। ‘বিশ্বকাপ থেকে আর্জেন্টিনা ছিটকে যাবে, তাই কী হয়!’ তা হয় না বলেই লিওনেল মেসি সব ভুলে নিজেকে উজাড় করে খেললেন। গ্রুপ পেরিয়েছে। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে আর্জেন্টিনা। অতীত ভুলে এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। জ্বলে উঠা আর্জেন্টিনাকে ভয় পাবে না কে!
এতে পুরনো প্রশ্ন নতুন করে উঠতে পারে—এই আর্জেন্টিনা কি সাম্পাওলির দল নাকি মেসির দল?
এসব নিয়ে সাম্পাওলির অবশ্য কোনো মাথাব্যথা নেই। মেসির স্বস্তিতে থাকা যে তার দলের সাফল্যের পূর্বশর্ত, সেটি ঘোষণা দেন অকপটে, ‘যে কোচ লিওকে অনুশীলন করায়, সে জানে, ও যেন স্বস্তিতে থাকে—সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যদি লিওকে পাস দিতে পারি, তাহলে গোলের সুযোগ তৈরি হবে। নইলে ভুগতে হবে আমাদের। বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় আমাদের সঙ্গে আছে। বাকিদের এর ফায়দা নিতে হবে। সেটি ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে করতে পারিনি। এ কারণেই ওই ম্যাচের পর বলেছিলাম, এটি আমাদের সমস্যা, লিওর না।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি ম্যাচের সময়ই মেসি দেখায় ও কী অসাধারণ খেলোয়াড়! অন্য সবার চেয়ে কত এগিয়ে। তবে সতীর্থদের কাছ থেকে ওর সমর্থন প্রয়োজন। তাহলেই শুধু ও নিজের সেরাটা খেলতে পারে। মেসির মানসিক দিক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর্জেন্টিনার জার্সিতে খারাপ সময়ে অন্যদের মতো ও কাঁদে; ও ভোগে। আবার জেতার পর আনন্দ করে। এই অনুভূতিগুলো সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়াটাও বড় ব্যাপার। অনেকে বলে, আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা লিও উপভোগ করে না। আমি এর সঙ্গে একমত নই।’
ম্যাচ শেষে মেসি গিয়ে জড়িয়ে ধরেন সাম্পাওলিকে। সেটি আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোচকে, ‘লিও যখন ম্যাচ শেষে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, সেটি আমাকে খুব আনন্দিত ও গর্বিত করেছে। কারণ ও জানে, কত আবেগ দিয়ে আমি প্রতিদিন আর্জেন্টিনা কোচের দায়িত্ব পালন করি। ও আমাকে ভালোভাবে জানে। জানে, আমরা কী স্বপ্ন নিয়ে রাশিয়ায় এসেছি। স্বপ্নটা হচ্ছে, আর্জেন্টিনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু অর্জনের। আমাদের ফুটবলাররা হৃদয় দিয়ে খেলে। ওরা সত্যিকারের বিপ্লবী।’
হাভিয়ের মাসচেরানো বলেন, নাইজেরিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টির কারণে বাদ হয়ে গেলে সে দায় আমারই হতো। কেননা আমি স্কোয়াডের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সদস্যদের একজন। তবে এখন আর কোনো কিছুকেই ভয় নাই।
গনসালো হিগুয়াইন বলেন, ‘মার্কোসের গোল আমাদের অনেক আনন্দ ও স্বস্তি এনে দিয়েছে। দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়াটা আমাদের প্রাপ্য। এখন আমাদের জন্য বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে।’