করোনার সবচেয়ে ভয়ের কারন উপসর্গহীন সংক্রমণ। স্বাভাবিক জ্বর, সর্দি বা কাশির লহ্মণ ছাড়া সেই রোগীর সংখ্যা বরিশালে বাড়ছে দিনদিন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আতঙ্ক ছড়িয়েছে সবখানে। চিকিৎসা পেশায় সম্পৃক্ত কেউ কেউ ধারণা করছেন, বরিশাল বিভাগে ইতিমধ্যে ৪০/৪২ শতাশেংর ওপর মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন এই ভাইরাসে। আর তা হয়েছে, অসচেতনতা এবং স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলার কারনে।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ বাসুদেব কুমার দাস জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সেবা নিতে এসে অনেকেরই এখন করোনা পজেটিভ দেখা যাচ্ছে। কভিড-১৯ এর নির্ধারিত উপসর্গ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। কিন্তু পরীক্ষা করালে দেখা যায় তিনি করোনা আক্রান্ত।
এই কর্মকর্তা বলেন, এটি উদ্বেগের কারন। এই অঞ্চলের মানুষকে প্রকৃতপক্ষে সচেতন করে রাখা সম্ভব হয়নি। প্রশাসন কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তারপরও মানুষ সচেতন হচ্ছেন না। স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। ফলে অধিকহারে সংক্রমিত হয়ে পড়ছে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ৬১ জন পদস্থ পুলিশ সদস্য করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে রয়েছেন, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার প্রলয় চিসিম, কোতয়ালী মডেল থানার তদন্ত ওসি আবদুর রহমান মুকুলসহ এসআই, এএসআই ও কনস্টেবল।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমার্স চেইন রিএ্যাকশন (আরটি পিসিআর) ল্যাব সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের যতজনের করোনা পজেটিভ এসেছে তার অধিকাংশই নির্ধারিত চেকআপে শনাক্ত হয়েছেন। যারা এখন পর্যন্ত শনাক্ত তাদের কয়েক জনের মৃদু উপসর্গ ছিল। আবার অনেকের কোন উপসর্গই ছিল না। কিন্তু পরীক্ষা করাতে এসে দেখা গেলো উপসর্গহীনদের মাঝেই করোনা পজেটিভ। দিন দিন এই রোগীর সংখ্যা বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানিয়েছে ল্যাবটির কর্মরতরা।
মূলত, বিগত ১১ মে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর জোনের অতিরিক্ত উপ- কমিশনার আবুল কালাম আজাদের গাড়ি চালকের করোনা শনাক্ত হয়। এরপরই বিএমপি সিদ্ধান্ত নেয় ধারাবাহিকভাবে সকল পুলিশ সদস্যের করোনা টেস্ট করানো হবে। ধারাবাহিক চেকআপ করাতে গিয়ে অনক উপসর্গহীন পুলিশ সদস্য রিপোর্ট পাচ্ছেন করোনা পজেটিভ।
সর্বশেষ করোনা পজেটিভ আসা বরিশাল মেট্রেপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার প্রলয় চিসিম জানান, নূন্যতম কোন লহ্মণ তার মাঝে ছিল না। বস্তুত মেট্রোপুলিশের অনেক সদস্য দিনি দিন আক্রান্ত হচ্ছেন। তাছাড়া শুরু থেকেই জনসম্পৃক্ত হয়ে কাজ করেছেন তিনি। সেই কারনে কৌতূহলবশে ২৯ মে করোনা টেস্টের নমুনা দিয়ে আসেন। ৩১ মে রাতে শেবাচিমের ল্যাব থেকে জানানো হয় তিনি করোনা পজেটিভ। এই কর্মকর্তা মনে করেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের কারনে তিনিও সংক্রমিত হয়েছেন।
পুলিশ সদস্যদের বাইরে গতকাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক অরিন্দম বড়াল, প্রিয়াংকা দাস, তৌফিক এলাহি আহাদের রিপোর্ট করেনা পজেটিভ এসেছে। তাদের সাথেও আলাপ করে জানা গেছে, দীর্ঘদিন হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করায় মনের সন্দেহে করোনা পরীক্ষা করালে ফলাফল সংক্রমিত আসে।
আক্রান্তরা মনে করছেন, ‘কভিড-১৯ শুধু বরিশাল বিভাগে নয়; দেশের কোন অঞ্চলেই নিয়ন্ত্রিত নেই।’
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে কাজ করা দু’জন চিকিৎসক বলেন, সবার টেস্ট করানো সম্ভব হলে কত শতাংশ সংক্রমতি তা বলা যেত। এখন বলা অসম্ভব। তবে ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করা যায় মানুষের অবাধ বিচরণ, স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করায় দক্ষিণাঞ্চলের ৪০/৪২ শতাংশের উপরে মানুষ কোন না কোনভাবে সংক্রমিত হয়ে পড়েছেন।
এই হাসপাতালের আরটি পিসিআর ল্যাবে দায়িত্ব পালন করা একজন নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, যারা পরীক্ষা করাতে আসেন তাদের ফলাফলটি জানা যায়। যারা আসেন না তাদের বিষয়ে জানা অসম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলেন, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্য করোনা আক্রান্ত এমন খবর প্রত্যেকদিন আমরা দেখি। মানুষও অপেক্ষা করে আজ কতজন পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে জানার জন্য। এই যে প্রতিদিন পুলিশ সদস্যের কারও কারও করেনা পজেটিভ আসছে-এর কারন তারা পরীক্ষা করাতে আসছেন। উপসর্গ না থাকায় যদি না আসতেন তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তিও জানতে পারতেন না যে তিনি করোনা পজেটিভ। ল্যাবের দায়িত্বশীল এই মানুষটি মনে করেন, বিপর্যয় থেকে বাঁচতে হলে দক্ষিণাঞ্চলে করোনার ল্যাব আরও বাড়ানো দরকার এবং প্রত্যেক মানুষের করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করানো উচিত।
স্বাস্থ্য দফতর বলছে, যারা পিসিআর ল্যাবে করোনা পরীক্ষা করাতে এসেছেন তারমধ্যে ৫.৬ শতাংশ মানুষ করেনা আক্রান্ত এসেছে। এখন পর্যন্ত বিভাগে যে কয়কোটি জনসংখ্যা, তারমধ্যে ১০ হাজার ৮৬৬ জন করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন। পরীক্ষা করাতে আসা ১০ হাজার ৮৬৬ জনের মধ্যে ৬০৮ জনের করোনা পজেটিভ এসেছে। সেই ৬০৮ জনের মধ্যে ৩৪২ জনের বয়সের মাত্রা ২১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এটিও আরকেটি উদ্বেগের কারন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের করোনা রোগ স্ট্যাডি করলে দেখা যায় বয়স্করা সংক্রমিত বেশি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে, বিশেষ করে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় (বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর) বেশিই আক্রান্ত হচ্ছেন কিশোর-যুবকরা।
এই অঞ্চলে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী সাধারণ মানুষের উদাসীনতা। এ কথা বলছিলেন স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ বাসুদেব কুমার দাস। এই কর্মকর্তা বলেন, লঞ্চ-বাস সীমিত আকারে চালু হওয়ার পর দেখেছেন মানুষ কিভাবে ভিড় করেছে। বাস/লঞ্চ কর্তৃপক্ষও কিন্তু সরকারি নির্দেশনা মানছেন না। সরকার ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে, তারপরও গাদাগাদি করে লোক নিয়ে যাত্রা করছেন। বাংলাদেশে সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে নির্দেশনা না মেনে চলার স্বভাবটাই বেশি দায়ী। এ কারনে কমিউিনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। তাই দিন দিন আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে।
বরিশাল জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মনোয়ার হোসেন মনে করেন, এখন পর্যন্ত উপসর্গহীন অথচ পরীক্ষা করাতে এসে পজেটিভ আসছে সেই রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। কিছুদিন আগেও সেটি ছিল না। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মানুষের অবাধ বিচরণই এই খারাপ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত বিএমপিতে যে ৬১ জন পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন তারা কিন্তু করেনার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করতে গিয়েই আক্রান্ত হয়েছেন।
এই কর্মকর্তা বলেন, জনগণের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রায় দুই হাজার সদস্য দিনরাত কাজ করছে। নিয়মিত টহল, করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থাও করছেন তারা। পাশাপাশি করোনা শনাক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেয়া, কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা, শ্রমজীবী মানুষকে সহায়তা, রাস্তায় জীবাণুনাশক সিটানো, অসহায়-কর্মহীন মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছানোর মত কাজ নিয়মিতই করছেন পুলিশ সদস্যরা। রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যারা পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখা হচ্ছে। তাছাড়া আক্রান্ত যারা তাদের সবার যে উপসর্গ ছিল তেমন নয়, অনেকেরই উপসর্গ ছিল না।