স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে এ রকম একটি প্রশ্ন থাকত এবং তার অনিবার্য উত্তর হতো ‘বরিশাল’। বৃহত্তর বরিশাল মানে দক্ষিণাঞ্চলের এখনকার ছয়টি জেলা: বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও ভোলা। আশার কথা, সেই বরিশালে আজ রেললাইন স্থাপনের তোড়জোড় চলছে। পদ্মা সেতু চালু হলে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত যে রেললাইন আছে, সেটি প্রথমে যাবে বরিশাল পর্যন্ত। এরপর বরিশাল থেকে পায়রা সমুদ্রবন্দর তক সেটি সম্প্রসারিত হবে। খুলনা থেকে মোংলা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত আরেকটি রেললাইন চালুরও পরিকল্পনা আছে সরকারের। সে ক্ষেত্রে দুটি সমুদ্রবন্দরই রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। আর এর থেকে বরিশালের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারেরও কম।
ঢাকা থেকে মাওয়া ফেরিঘাট পার হলেই দেখা যায় উন্নয়নের মহাযজ্ঞ। চার লেন সড়ক হচ্ছে। নতুন রেললাইনের কাজ চলছে। ঢাকা থেকে বরিশালের দূরত্ব ২৪৫ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু হলে সাড়ে চার ঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে। এখন লাগে আট থেকে দশ ঘণ্টা।
স্থানীয় কয়েকজন শিল্পোদ্যোক্তা–ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন- পদ্মাসেতু হলে তখন বরিশাল হবে ব্যবসা–বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। শুধু পদ্মা সেতুর কথা কেন? পায়রা সমুদ্রবন্দর, রেললাইন, ভারতের সঙ্গে সড়ক ও নৌ–যোগাযোগ বৃদ্ধি—এ সবই বরিশালের অর্থনীতিকে চাঙা করবে। তাঁরা হিসাব দিয়ে বলেন- বরিশালে প্রচুর শস্য উৎপাদিত হয়। নদীতে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। বরিশালের ইলিশের সুনাম আছে। পদ্মায় এখন আর ইলিশ তেমন পাওয়া যায় না। মেঘনার ইলিশই দেশের চাহিদা মেটায়। যোগাযোগের ভঙ্গুরতার কারণে বরিশালের শিল্পোদ্যোক্তারা ঢাকা ও এর আশপাশে গিয়ে তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছেন। পদ্মা সেতু চালু হলে তাঁরাও এখানে ফিরে আসবেন। এখানে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। কেন তাঁরা এখানে আসবেন? ব্যবসায়ীদের যুক্তি হলো, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য যেতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। বরিশাল থেকে পায়রা ও মোংলা যেতে লাগবে ২ ঘণ্টা। পরিবহন খরচ অনেক কমে যাবে।
বর্তমানে বরিশালে কয়েকটি ওষুধ, সিমেন্ট কারখানার বাইরে বড় কোনো শিল্প নেই। ১৩৩ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত বরিশাল বিসিক নগরীতে ফরচুন নামে একটি বড় জুতার কারখানা থাকলেও এর বেশির ভাগ প্লট খালি পড়ে আছে। তাঁরা বললেন, এই বিসিক নগরীতেই অনেক কারখানা হতে পারে। এ ছাড়া সরকার আগৈলঝাড়ায় একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নিয়েছে।
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু সাম্প্রতিকালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনারে বরিশাল অঞ্চলে আরও শিল্প–কারখানা গড়ে তোলার তাগিদ দিয়ে বললেন, কেউ উদ্যোগ নিলে ব্যাংকঋণসহ সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।
শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি সাইদুর রহমান জানালেন, এখানে কৃষিপণ্য ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা করতে পারলে যেমন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে, তেমনি অনেক কর্মসংস্থান হবে। তাঁর প্রত্যাশা, দক্ষিণাঞ্চল আর অবহেলিত থাকবে না। বরিশাল হবে বাংলাদেশের সিঙ্গাপুর।
এত দিন বরিশালে শিল্প–কারখানা হলো না কেন? তিনি বললেন, বিদ্যুতের সমস্যা ছিল। কিন্তু ভোলায় প্রচুর গ্যাস পাওয়া গেছে। পায়রা সমুদ্রবন্দরের কাছে কয়লাভিত্তিক থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরির কাজও চলছে চীনের সহায়তায়। এ ছাড়া সেখানে একটি এলএনজি টার্মিনাল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। তাঁরা আশা করছেন, শিগগিরই ভোলা থেকে গ্যাস আনা যাবে। ভোলার রাজনীতিকেরা এর আগে বলেছিলেন, ভোলার গ্যাস ভোলায়ই থাকবে। সম্প্রতি তাঁরা ভোলার বাইরে গ্যাস দিতে রাজি হয়েছেন। তবে তাঁদের শর্ত বরিশাল ও ভোলার মধ্যে যে নদী আছে, সেখানে সেতু তৈরি করতে হবে। তাতে ভোলা ও বরিশালের মানুষ উপকৃত হবেন। উন্নয়ন তো একতরফা হয় না। ‘দেবে আর নেবে মেলাবে মিলিবে।’
ভোলার গ্যাস শুধু বরিশাল নয়, খুলনাসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলের চাহিদা মেটাবে বলে আশা করা যায়। গ্যাস–সুবিধা পেলে এবং যোগাযোগ সহজ হলে উদ্যোক্তারা বরিশাল অঞ্চলে কারখানা করতে উৎসাহী হবেন। বর্তমানে এখানকার হাজার হাজার শ্রমিক বরিশালের বাইরে বিভিন্ন কারখানায় কাজ করেন। বরিশাল শিল্পায়িত হলে তাঁরা নিজের জেলায় থেকে কাজ করতে পারবেন।
বরিশাল অঞ্চলে আরও যেসব শিল্প–কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আছে বাউফলে একটি রাইস অটোমেশন কারখানা, পাথরঘাটায় জাহাজভাঙা শিল্প।
পটুয়াখালীর কুয়াকাটা দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রসৈকত, যেখান থেকে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দুটোই দেখা যায়। কুয়াকাটায় অনেক হোটেল ও মোটেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পদ্মা সেতু হলে আরও বেশিসংখ্যক পর্যটক আসবেন। তবে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বরিশাল বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে হবে, যাতে তাঁরা সরাসরি বরিশালে এসে কুয়াকাটা যেতে পারেন। প্রকৃতিগতভাবে পায়রা বন্দর টেকসই নয় বলে অনেক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন। এ বিষয়ে বরিশালের এক ব্যবসায়ীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এসব গুজব চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ছড়াচ্ছেন। তাঁরা চান পুরো বাংলাদেশের পণ্য একটি বন্দর দিয়ে যাক। কিন্তু তাতে তো বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার যেভাবে বাড়ছে তাতে শুধু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভবিষ্যতে ৮০–৯০ শতাংশ পণ্য খালাস করা সম্ভব হবে না। আমাদের আরও নতুন নতুন বন্দর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গত মে মাস পর্যন্ত পায়রা বন্দর ১০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করেছে। এখন বন্দর উন্নয়নের কাজ চলছে। পুরোদমে চালু হলে আয় অনেক বাড়বে।
বরিশালের ব্যবসায়ীরা চান সেখানে একটি ফিশল্যান্ডিং স্টেশন হোক, দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য হিজলায় ২ হাজার একর জমি বরাদ্দ রয়েছে। তাঁদের আক্ষেপ বরিশালে বিভাগীয় স্টেডিয়াম না হওয়ায় এবং পাঁচতারা মানের হোটেল না থাকায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হতে পারছে না।
ভারতের সঙ্গে নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তাঁরা মনে করেন, গাবখান সুয়েজ ক্যানেলের ভূমিকা পালন করতে পারে। অতীতে ঢাকা-কলকাতার মধ্যে এই গাবখানই ছিল নৌ–যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। নদীগুলো যাতে ভরাট না হয়ে যায়, ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রয়োজন। কম খরচে এর সহনীয় পরিবেশে পণ্য পরিবহন করা যাবে।