লাদাখ সীমান্ত নিয়ে চীন-ভারতের মধ্যেকার উত্তেজনার নিরসনে কাজ করছে রাশিয়া। গালওয়ান উপত্যকায় ১৫ জুন রক্তপাতের পরেই চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ই’র সঙ্গে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্করের ফোনালাপের পিছনেও মস্কোর হাত রয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে এমন খবর প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার।
গত দু’সপ্তাহ ধরেই চীনের সঙ্গে সংকট সমাধানে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে চলছে ভারত। সম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে গত তিন সপ্তাহে রাশিয়ার বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং মস্কোয় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। আজকের চীন-ভারত-রাশিয়ার বৈঠকটির পিছনেও সক্রিয় মস্কো।
এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও সে দেশের বিজয় উৎসবে যোগ দিতে মস্কো পৌঁছেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। এই উৎসবে যোগ দিতে আগামীকাল রাশিয়া পৌঁছবেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও। চীনের সরকারি মুখপত্র গ্লোবাল টাইমস রাজনাথের সঙ্গে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে বলে দাবি করেছে। তবে সেই দাবি উড়িয়ে দিয়েছে ভারত। রাজনাথ এ দিন রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী সরঞ্জাম আমদানি করার বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। চলতি বছরের শেষে ওই সরঞ্জাম ভারতে আসার কথা। কিন্তু তা দ্রুত সরবরাহ করা নিয়ে আজ রুশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছেন ভারতের এই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।
দীর্ঘ বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আবারো বাড়ানোর ফলে কি কৌশলগত অংশীদার আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য কিছুটা বিঘ্নিত হবে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বিষয়টিকে কীভাবে দেখবে, রাশিয়াই বা কেন চীন-ভারত দ্বন্দ্ব মেটাতে এতো আগ্রহ দেখাচ্ছে- এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে কূটনীতিবিদরা বলেছেন, প্রত্যেকটি দেশ নিজের স্বার্থের জন্য অন্য দেশকে কাজে লাগাচ্ছে। এক একজনের স্বার্থ এক এক রকম। সেই স্বার্থ যেমন এক দিকে বাণিজ্যিক, পাশাপাশি ভূকৌশলের খেলাও তার সঙ্গে জড়িয়ে। গোটা বিষয়টিতে আমেরিকার খুশি হওয়ার কারণ নেই এটা ঠিকই। কিন্তু একে কেন্দ্র করে নতুন করে ভারত-আমেরিকা মত বিরোধ তৈরি হবে — এমনটাও মনে করা হচ্ছে না। দু’দিন আগেই ট্রাম্প জানিয়েছিলেন তিনি ভারত-চীনের এই সঙ্কটে মধ্যস্থতা করতে চান। এটা ঘটনা যে, ‘ডিল মেকিং’ ট্রাম্পের অত্যন্ত প্রিয় অভিষ্ট। এ ক্ষেত্রে তাকে অবজ্ঞা করে ভারতের রাশিয়া-সংযোগ তিনি যে ভাল চোখে দেখবেন না, এটাই স্বাভাবিক।
তারা আরো জানান, আমেরিকা-রাশিয়ার বর্তমান বৈরিতার আবহ থাকলেও ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিই চেয়ে এসেছেন। ফলে নয়াদিল্লি যদি কোনো বিষয়ভিত্তিক কারণে মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়, তা হলে পরে নিজেদের প্রয়োজনে রাশিয়ার কাছে পৌঁছতে ভারতকে কাজে লাগাতেই পারে আমেরিকা।
এ বিষয়ে অতীতের উদাহরণ টেনে সাবেক কূটনীতিক রণেন সেন বলেন, আফগানিস্তান সমস্যার সমাধানের জন্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীকে অনুরোধ করেছিলেন, তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের সঙ্গে কথা বলতে। তবে কূটনীতিকদের মতে, যা করা হবে, তা আমেরিকাকে অন্ধকারে রেখে না করাটাই শ্রেয়।
অন্য দিকে নয়াদিল্লির যুক্তি, চীন-ভারত সম্পর্কের মধ্যে আমেরিকাকে টেনে আনলে বর্তমান পরিস্থিতিতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। কারণ ট্রাম্প এবং শি জিংপিং’র সম্পর্ক এখন প্রতিকূল অবস্থানে। এখন যদি বেইজিং কারো কথায় কিছুটা গুরুত্ব দেয়, তা হল মস্কো। দুদেশের বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য স্বার্থ একে অন্যের সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি মস্কোও চায়, তাদের সামরিক পণ্যের বিশাল দুই ক্রেতা, ভারত এবং চীনের মধ্যে অস্থিরতা যেন মাত্রাছাড়া পর্যায়ে না পৌঁছয়। কারণটা যে শুধু বাণিজ্যিক তাই নয়, এর ভূকৌশলগত দিকও রয়েছে।
এই মুহূর্তে রাশিয়া-চীন-ভারত (রিক), ব্রাজিল, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা (ব্রিকস) এবং সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) চলতি বছরের নেতৃত্ব মস্কোর হাতে। ভারত এবং চীন এই তিনটি জোটেই রয়েছে। সূত্রের মতে, রাশিয়া আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষার্থে এই গোষ্ঠীগুলোকে কাজে লাগাতে উন্মুখ। সে ক্ষেত্রে চীন-ভারতের সহাবস্থান মস্কোর জন্যও জরুরি।