খান রুবেলঃ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে গত ২৬ জুন থেকে। সেতু উদ্বোধনের পর দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন সড়কে যানবাহনের চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু বাড়েনি মহাসড়কগুলোর প্রশস্ত। যার ফলে সরু রাস্তায় যানবাহন চলাচল করতে গিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা।গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের হিসেব বলছে, পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরুর পর থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়কে ছোট-বড় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে নারী এবং শিশুসহ ২৮ জন। যার মধ্যে ২০ এবং ২১ জুলাই ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে সবথেকে বড় দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে বাকেরগঞ্জ ও উজিরপুরে। এই দুটি ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১২ জন। আহত হয়েছেন অন্তত ১২ জন। তাছাড়া যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগ বরিশাল জেলার সীমান্ত গৌরনদীর ভুরঘাটা থেকে বাকেরগঞ্জের লেবুখালীর মধ্যে।বিশ্লেষকরা বলছেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরে যানবাহনগুলোতে বেড়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আগে যাওয়ার প্রবণতায় এই পরিস্থিতির তৈরী হয়েছে। এর পেছনে যাত্রীদের অসাবধানতা, মহাসড়কে অবৈধ যানবাহন, অদক্ষ চালক, প্রশিক্ষণের অভাব, ফিটনেসবিহীন যানবাহন প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ভাঙ্গা থেকে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েসহ ফোরলন সড়কে উন্নিত করার পাশাপাশি মহাসড়ক সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই সাথে যানজট এড়াতে মহাসড়কের পাশের হাট-বাজার, সড়কের ওপর নির্মিত বাস ও পরিবহন কাউন্টার, থ্রি-হুলারের স্ট্যান্ড নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়া উচিত।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২১ জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর নামক এলাকায় বেপরোয়াগতির অজ্ঞাতনামা ট্রাকের চাপায় সাইফুল ইসলাম নামের এক মোটরসাইকেল চালক যুবক ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছেন। এসময় আহত হয়েছেন এক আরোহী। একই দিন বেলা সোয়া ১২টার দিকে মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার নতুন শিকারপুর এলাকায় থামিয়ে রাখা মাইক্রোবাসকে মোল্লা ট্রাভেলসের একটি বাস ধাক্কা দিলে মাইক্রোবাসে থাকা কুয়াকাটার ছয় পর্যটকের মৃত্যু হয়। বাস যাত্রীসহ আহত হন অন্তত ১০-১২ জন।এর আগে ২০ জুলাই একই মহাসড়কের বাকেরগঞ্জ উপজেলার ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সামনে বিআরটিসি বাসের চাপায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের চালক, ১৮ মাসের এক শিশু, তার মা এবং খালাসহ ছয় যাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরও একজন।এর আগে গত ১৫ জুলাই ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদী মাহিলারা ইউনিয় পরিষদের সামনে পাজেরো’র ধাক্কায় মো. আব্দুল মালেক (৬০) নামের একজন ভ্যানচ্যালক নিহত হন। ১২ জুলাই সকাল পৌনে ৭টার দিকে একই মহাসড়কের গৌরনদী টরকি বাজার সংলগ্ন ব্রিজের উত্তর প্রান্তে বাস ও তেলের লরির মধ্যে সংঘর্ষে লরি চালক মোক্তার মোল্লা (৫০) নিহত হন। আহত হন বাসের ছয় যাত্রী।১১ জুলাই বিকেলে উজিরপুরের নতুন শিকারপুর মহাসড়কে বাস চাপায় মৃত্যু হয় মো. আলমগীর (৫০) নামের এক ভ্যান চালকের। ৮ জুলাই গৌরনদীর পশ্চিম বেজহার এলাকায় দুর্ঘটনায় নিহত হন মোটরসাইকেল চালক আব্দুর রহমান (৩০)। ৬ জুলাই উজিরপুরের ইচলাদী টোল প্লাজা এলাকায় মোইক্রোবাসের চাপায় বেল্লাল হোসেন শেখ (৪০) নামের একজন মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। একইদিন গৌরনদীর খাঞ্জাপুরে দুই বাসের সংঘর্ষে ৩২ জন এবং বরিশালের কাশিপুর বাঁশতলা নামক এলাকায় বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই জন আহত হয়েছে।২৫ জুন উজিরপুরের বামরাইলে বাস-কাভার্ডভ্যান ও থ্রি-হুইলারের ত্রিমুখী সংঘর্ষে কাভার্ডভ্যান চালক আবিদ আলী (৪২) এর মৃত্যু হয়।এদিকে, বরিশাল জেলার বাইরেও কয়েকটি দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০ জুলাই রাত ৯টার দিকে বরগুনার বেতাগী উপজেলার ঝোপখালি এলাকায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় দীপক হালদার (৫৫) নামের এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। এর আগে ১৭ জুলাই বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের আমতলী উপজেলার শাখারিয়া এলাকায় যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে রিয়াদ (৩৫) নামের এক যুবক নিহত হন। এই ঘটনায় আহত হন কমপক্ষে সাতজন।২ জুলাই মঠবাড়িয়া-ভান্ডারিয়া সড়কের তুষখালী কলেজ সংলগ্ন সড়কে বাসচাপায় মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও মো. হিরন মিয়া নামের দুই গরু ব্যবসায়ী নিহত হন। এই ঘটনায় আহত হন আরও দু’জন। ৬ জুলাই পিরোজপুর-ঢাকা মহাসড়কের নাজিরপুর উপজেলার শৈলদাহ এলাকায় বাসচাপায় আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩২) নামের একজন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নিহত হন।২৯ জুন সকালে বরিশাল-স্বরূপকাঠি সড়কের নেছারাবাদ কুড়িয়ানা বাজার এলাকায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পরিমল বেপারী (৪৫) নামের একজন পথচারী নিহত হন। আহত হন মোটরসাইকেল আরোহী।১৬ জুলাই ভোরে বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের মৌকরণ ব্রিজের কাছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে পড়ে ২০ যাত্রী আহত হয়। ১৬ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভোলা-চরফ্যাশন সড়কের লালমোহন উপজেলার ডা. আজাহার উদ্দিন কলেজের কাছে বাসে উঠতে গিয়ে ছিটকে রাস্তায় পড়ে চিত্তরঞ্জন দাস (৬০) নামের এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন।ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কে হঠাৎ করে দুর্ঘটনার প্রবনতা বেড়ে যাওয়ায় অনেকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এই অঞ্চলের মানুষ। দাবি তুলেছেন নিরাপদ সড়কের। নিরাপদ সড়ক চাই বরিশালের আহ্বায়ক রুহুল আমিন বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির গতিসঞ্চার বাড়িয়েছে। সেতু উদ্বোধনের পর এই অঞ্চলে যানবাহনের চাপ কয়েকগুণ বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে আগে যাওয়ার প্রবনতা। চালকরা কত দ্রুত বরিশাল থেকে ঢাকা বা ঢাকা থেকে বরিশালে পৌঁছাতে পারে সেই প্রতিযোগিতা বেড়েছে। কিন্তু সড়ক প্রশস্ত হয়নি। বর্তমান সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার এটি একটা বিশেষ কারন।তিনি যোগ করেন, সড়কে অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। যেমন বাকেরগঞ্জে ইজিবাইককে যে বিআরটিসি বাসটি চাপা দিয়েছে সেটা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে মহাসড়কে চলাচল করে আসছিল। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আমি মনে করি এখানে বিআরটিএ’র ভূমিকা বাড়ানো উচিত। তাদের নজরদারির অভাবে অবৈধ যানবাহনে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই সড়ক-মহাসড়কে বিআরটিএ’র তদারকি জরুরি বলে মনে করেন নিরাপদ সড়কের এই সংগঠক।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশাল জেলার সভাপতি প্রফেসর শাহ্ সাজেদা বলেন, বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনার যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে করোনার থেকে বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। সড়কের তুলনায় ছোট যানবহনের সংখ্যা বেড়েছে। চালকরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। বড় গাড়ি যারা চালায় তাদের মধ্যে একটা ভাব কাজ করে। তারা ইস্টিয়ারিং ধরলেই মনে হয় যেন বিমান চালাচ্ছেন, বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। তারা ইচ্ছা মতো গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণে আগে চালকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতার বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহাসড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং শৃঙ্খলা ফিরাতে কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশ। চলতি মাসের ২২ দিনেই মহাসড়কে বিভিন্ন যানবহনে সড়ক পরিবহন আইনে ৩০০টি মামলা দিয়েছেন তারা। এর মধ্যে ২০০টি মামলা হয়েছে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালোনার কারণে। এর পরেও বেপরোয়া গতি থামছে না বলে মন্তব্য করেছেন বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের গৌরনদী হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ মো. বেল্লাল হোসেন।তিনি বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরে মহাসড়কে যানবাহনের প্রতিযোগিতা বাড়ছে। এই প্রতিযোগিতা যে শুধু চালকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ সেটা কিন্তু না, যাত্রীদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা বেড়েছে। কে কার আগে যাবে, আড়াই ঘন্টা-তিন ঘন্টায় গন্তব্যে পৌঁছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার মহাসড়কে যানবাহনের প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর আমি মনে করে এটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা।তিনি বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলেও দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কের প্রশস্ত বাড়েনি। তার মধ্যে যানবাহন কয়েকগুণ বেড়েছে। দুর্ঘটনা কমানোর পাশাপাশি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা নিয়মিত স্পীডগান নিয়ে চেকপোস্ট বসাচ্ছি। আমাদের চেকপোস্ট দেখলে গাড়ির গতি কমে যায়। আবার চেকপোস্ট অতিক্রম করার পর পরই গতি বেড়ে যাচ্ছে। মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এখন সিসি ক্যামেরার বিকল্প নেই জানিয়ে ওসি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঝুঁকি নিয়ে পদ্মা সেতুর মতো অসাধ্যকে সাধন করে দেখিয়ে দিয়েছেন। এখন দক্ষিণাঞ্চলে এক্সপ্রেসওয়ে এবং ফোরলেন সড়ক সময়ের দাবি। এটা হলে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করছেন হাইওয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা।