বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের চারমাস পরও এর হার ঊর্ধ্বগতি, ধীরে ধীরে তা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। এই সময় নমুনা পরীক্ষা ব্যাপক হারিয়ে বাড়িয়ে লকডাউন কার্যকর ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম জোরদার করার পরামর্শ থাকলেও উল্টো পথে হাঁটছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। কমেছে নমুনা পরীক্ষা; বরং পরীক্ষা করাতে ফি নির্ধারণের ফলে মানুষের মধ্যে এ নিয়ে অনীহা তৈরি হয়েছে।
ছোট ছোট এলাকা ধরে বৃহৎ পরিসরে লকডাউনের প্রস্তুতির শোনা গেলেও তা কার্যকরের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি স্থান ছাড়া দেশের কোথাও লকডাউন নেই। আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা ব্যাপকহারে কমেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আর মাত্র ১৮ দিন পর ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হবে। ঈদ সামনে রেখে সতর্ক হতে পরামর্শ দিয়েছেন করোনায় গঠিত কারিগরি পরামর্শক কমিটি। এ জন্য তারা বেশকিছু সুপারিশ করেছেন। তাদের পরামর্শ আমলে নিয়ে তা কার্যকরের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও করোনায় গঠিত কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অন্তত ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করার সুপারিশ করেছি। কিন্তু তা করা হয়নি; বরং পরীক্ষা কমিয়েছে। এর ফলে সংক্রমণ বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ঈদকে সামনে রেখে আরও কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর বেশিকিছুকরার এখতিয়ার কমিটির নেই। এখন তা আমলে নেওয়ার বিষয়টি সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের। আমাদের সুপারিশগুলো আমলে আনলে সংক্রমণ ঠেকানো যাবে। নইলে সংক্রমণ বাড়বে, সঙ্গে মৃত্যুও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে করোনা আক্রান্ত ও নমুনা সংগ্রহের যে তথ্য দেওয়া হয় তাতে দেখা যায়, গত ২৬ জুন ১৮ হাজার ৪৯৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল। ৬৬টি ল্যাবরেটরিতে এ পরীক্ষা করার তথ্য দেওয়া হয়। এখন ল্যাবের সংখ্যা ৭৭টি হলেও পরীক্ষা কমেছে ব্যাপকহারে। গতকাল রবিবারও মাত্র ১১ হাজার ৫৯টি পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু শনাক্তের হার ছিল ২৪ দশমিক ১১ শতাংশ। গত ৮ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমণের পরদিন থেকে এখন পর্যন্ত এটিই সংক্রমণের সর্বোচ্চ হার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, রবিবার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১১ হাজার ১৯৩টি, এর আগের দিন ১৩ হাজার ৪৮৮, তারপরও আগের দিন শুক্রবার ১৫ হাজার ৬৩২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ১৫ হাজার ৬৭২, বুধবার ১৩ হাজার ১৭৩, মঙ্গলবার ১৪ হাজার ২৪৫, সোমবার ১৩ হাজার ৯৮৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। অর্থাৎ গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এভাবে নমুনা পরীক্ষা কমেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বরাবরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে কিটের কোনো সংকট নেই। পর্যাপ্ত পরিমাণ কিট রয়েছে। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি প্রতিদিন অন্তত ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু দেশের বিভিন্ন ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ নমুনা পরীক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চাহিদা থাকলেও এর বেশি নমুনা পরীক্ষা তারা করতে পারছেন না। আবার উপসর্গ ছাড়া নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে না। যদিও দেশের আক্রান্তদের বড় অংশ উপসর্গহীন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নমুনা পরীক্ষায় ফি নেওয়ার বিষয়টি। এ কারণে মানুষের মাঝে পরীক্ষা করার আগ্রহ কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মোকাবিলার একটি দিক হচ্ছে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ। এরপর আসে চিকিৎসার বিষয়টি। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউন সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হলেও বাংলাদেশে এর বালাই নেই; বরং সবকিছু এখন স্বাভাবিক পর্যায়ে। অফিস-আদালত খুলেছে। ব্যবসায়িক কার্যক্রমও চলছে। অনেকদিন ধরে জোনভিত্তিক লকডাউনের কথা শোনা গেলেও এখন তা আর হচ্ছে না বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ, সামনে কোরবানির ঈদের কারণে তা সম্ভব হবে না।
রাস্তাঘাটের দৃশ্য দেখলে মনে হবে না বাংলাদেশে করোনার মহামারী ভয়াবহ পর্যায়ে রয়েছে। সর্বত্র অনেক মানুষকে মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, নিয়মিত বিরতিতে হাত ধোয়ার যে অভ্যাস গড়ে উঠেছিল তা আগের মতো নেই। সাধারণ মানুষকে এসব মানতে বাধ্য করার দায়িত্ব থেকে সরে এসেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
জানা গেছে, সরকার নির্ধারিত কোভিড-১৯ চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতালগুলোর ৭৫ শতাংশ শয্যা খালি। এজন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নাজুক অবস্থাকে দায়ী করা হচ্ছে। যখন করোনা সংক্রমণের কারণে গুরুতর রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া জরুরি সেখানে অনেকে এখন বাড়িতে চিকিৎসাকালে মারা যাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতি এ ধরনের আস্থাহীনতা। কারণ, মানুষ হাসপাতালের চিকিৎসার ওপর আস্থা হারিয়েছে।
করোনায় গঠিত কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী, ঢাকাসহ চার বিভাগে কোরবানির পশুর হাটের বিকল্প চিন্তা করছে না সরকার। ঈদের সময় ঘরমুখী মানুষের স্রোত সামলাতেও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনা নেই।
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, কোনো কিছু সময়মতো এবং স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে না; বরং যখন যা হওয়ার তার উল্টো হচ্ছে না। এখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ধরনের জেদাজেদি দেখা যাচ্ছে না। তারা কারও পরামর্শ আমলে নিতে চাইছেন না। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তসহ নানা কাজে মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। তারা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।