বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা ভারতের আসাম রাজ্যে অবৈধ বাসিন্দাদের চিহ্নিত করার অংশ হিসেবে ‘জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি)’ দ্বিতীয় ও শেষ খসড়া তালিকা আগামী সোমবার প্রকাশ করার কথা রয়েছে। প্রথম তালিকায় বাদ পড়া প্রায় দেড় কোটি বাসিন্দা গভীর উত্কণ্ঠা নিয়ে ওই তালিকার অপেক্ষায় আছে। তালিকায় বাদ পড়া ব্যক্তিরা যদি নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হয়, তবে শেষ পর্যন্ত তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে তা-ও স্পষ্ট নয়।
এদিকে প্রকাশিতব্য খসড়া এনআরসি তালিকার ভিত্তিতে কোনো ধরনের প্রশাসনিক বা পুলিশি ব্যবস্থা না নিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গতকাল বুধবার আসাম রাজ্য সরকারকে নির্দেশনা দিয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এক টুইট বার্তায় ওই নির্দেশনার কথা জানান। একই দিন তিনি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বলেছেন, ‘ফরেনার্স অ্যাক্টের’ আওতায় ভারতে অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশিদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। ভারতে অবৈধভাবে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজিজু বলেছেন, আগামী সোমবার আসাম থেকে ৫২ জন অবৈধ বাংলাদেশিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে।
আসামে এনআরসি প্রক্রিয়ার আওতায় নাগরিকত্ব যাচাইয়ের ফলে বর্তমানে সেখানে বসবাসরত অনেকেরই নাগরিকত্ব হারানোর শঙ্কা রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন মহলের ধারণা, বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে লোকজন সেখানে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। নাগরিকত্ব হারালে তাদের বাংলাদেশে ফেরত আসতে হতে পারে—এমন শঙ্কাও রয়েছে।
তবে বাংলাদেশের সরকারি সূত্রগুলো এমন শঙ্কা নাকচ করলেও পরিস্থিতির দিকে নজর রাখার কথা জানিয়েছে। ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী গত সোমবার কলকাতায় সাংবাদিকদের বলেন, এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারত বিষয়টি বাংলাদেশের কাছে তোলেনি। তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশেরও কোনো মন্তব্য নেই।
গত ৩১ ডিসেম্বর রাতে প্রকাশিত এনআরসির প্রথম খসড়ায় আসামের তিন কোটি ২৯ লাখ আবেদনকারীর মধ্যে এক কোটি ৯০ লাখের নাম স্থান পায়। বাকি এক কোটি ৩৯ লাখ আবেদনকারীর আবেদন যাচাই-বাছাই করে দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে। তালিকায় স্থান পেতে আসামের বাসিন্দাদের প্রমাণ করতে হচ্ছে যে তাদের পূর্বপুরুষদের নাম ১৯৫১ সালের এনআরসিতে বা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের আগের কোনো ভোটার তালিকায় ছিল।
খসড়া এনআরসির দ্বিতীয় ও শেষ তালিকা প্রকাশের প্রাক্কালে গতকাল ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আসাম রাজ্য সরকার ও প্রতিবেশী রাজ্যগুলোকে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নির্দেশনা দিয়েছে। আসাম রাজ্য সরকারকে রাজ্যের ও কেন্দ্রের বিভিন্ন সংস্থা এবং এনআরসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় নিশ্চিত করতে রাজ্যসচিবের সভাপতিত্বে রাজ্যপর্যায়ের সমন্বয় কমিটি গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ গ্রহণ ও দ্রুত সমন্বিত উদ্যোগ নিতে রাজ্যের রাজধানী ও জেলা সদরগুলোতে সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করারও নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
ওয়েবসাইট, ‘টোলফ্রি’ নম্বর, এসএমএসসহ সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে জনগণের কাছে খসড়া এনআরসির তথ্য তুলে ধরতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছে। এনআরসি প্রক্রিয়া, খসড়া তালিকায় নাম না থাকা ব্যক্তিদের জন্য করণীয় বিষয়গুলো জনগণকে জানাতে ব্যাপক পরিসরে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং গত রবিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, প্রত্যেকেই ন্যায়বিচার পাবে। সবার সঙ্গেই মানবিক আচরণ করা হবে। আইন অনুযায়ী, প্রত্যেকেই পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে। ভারত সরকার স্পষ্ট জানাচ্ছে, আগামী ৩০ জুলাই এনআরসির খসড়া প্রকাশের পরও অভিযোগ ও দাবি জানানোর পর্যাপ্ত সুযোগ থাকবে। সব অভিযোগ ও দাবি যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খসড়া এনআরসির তালিকায় নাম না থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আসাম সরকারের প্রশাসনিক বা পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া ঠিক হবে না। তালিকায় বাদ পড়া ব্যক্তিদের ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে’ পাঠানোরও কোনো প্রশ্ন নেই। কারণ চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশের আগে তারা অভিযোগ ও দাবি জানানোর অধিকার রাখে এবং তারা তা পাবে।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরো জানায়, এনআরসির ভিত্তিতে কাউকে আটক করে ‘ডিটেনশন সেন্টারে’ পাঠানোরও সুযোগ নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব প্রশাসনিক ও পুলিশ শাখাকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিতে আসামের রাজ্য সরকারকে নির্দেশনা দিয়েছে।
জানা গেছে, আসামের এনআরসির খসড়া নিয়ে প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যগুলোতেও, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে শঙ্কা রয়েছে। প্রথম দফা তালিকা প্রকাশের পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারকে আগুন নিয়ে না খেলার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, এনআরসি হালনাগাদের নামে আসাম থেকে বাঙালিদের তাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আদালতের নির্দেশে আসামে এনআরসি তালিকা প্রকাশের কাজ চলছে। শেষ পর্যন্ত যারা নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবে না, তাদের ব্যাপারেও আদালত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।