বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখনো বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব, ব্যবসাসংক্রান্ত আইনের অপর্যাপ্ততা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৯ সালের বিনিয়োগ পরিবেশ বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর গত সপ্তাহে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিপুল তরুণ ও কর্মঠ জনশক্তি, ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় বিশাল বাজারগুলোর মধ্যে কৌশলগত অবস্থান এবং সক্রিয় বেসরকারি খাতে বাংলাদেশ আরো অধিক হারে বিদেশি বিনিয়োগ পেতে পারে। সরকারের নতুন কিছু উদ্যোগে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের অঙ্গীকার থাকলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন এখনো দেখা যায়নি বলে উল্লেখ আছে ওই প্রতিবেদনে। এ ছাড়া বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কাঠামো গ্রহণে ধীরগতি এবং ধীরগতির বিচারপ্রক্রিয়া চুক্তি ও ব্যবসা বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা।
দুর্নীতি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশে সরকারি ক্রয়, শুল্ক ও কর সংগ্রহ এবং নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি সাধারণ বিষয়। দুর্নীতি, বিশেষ করে ঘুষ বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ ও ঝুঁকি বাড়ায়। ঘুষের কারণে বাংলাদেশের জিডিপি ২ থেকে ৩ শতাংশ কম হয় বলে ধারণা করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোর সুযোগ এবং বড় পরিসরে বাজার পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। এটি বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দুর্নীতি বাংলাদেশে পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বাড়ায় এবং আইনের শাসনকে অবমূল্যায়ন করে।’
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনের তথ্যও আছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান মধবিত্তের কল্যাণে গত দশকজুড়ে ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশের বেশি বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এই প্রবৃদ্ধির অনেকটাই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৬.৬৬ বিলিয়ন (৩,৬৬৬ কোটি) মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। একমাত্র চীনই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় পাঠিয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের পরিসংখ্যান থেকে ধারণা পাওয়া যায়, ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ চার হাজার কোটি ডলারের পোশাক পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য পূরণের পথেই ছিল।
কৃষিভিত্তিক ব্যবসা, পোশাকশিল্প, চামড়াশিল্প, হালকা পণ্য উত্পাদন, জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ সরকার সক্রিয়ভাবে বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশের দেওয়া বিভিন্ন সুবিধার কথাও উল্লেখ আছে এতে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার এবং এর আগের অর্থবছরে ২৪৫ কোটি ডলার সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে এফডিআই প্রবাহের হার জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ। এটি এশিয়ায় সর্বনিম্ন পর্যায়ের বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার কূটনৈতিক জোনে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাসহ ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ধারাবাহিক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এর ফলে মার্কিন দূতাবাসের কর্মীসহ অনেক প্রবাসীর জন্য নিরাপত্তা বিধি-নিষেধ বাড়ানো হয়। মিয়ানমার থেকে নতুন করে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কারণে নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়ার তথ্যও রয়েছে প্রতিবেদনে।
গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম ও রাজনৈতিক সহিংসতার তথ্য তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনপূর্ববর্তী সময়ে সহিংসতা, হয়রানি ও দমন-পীড়নের কারণে বিরোধী অনেক নেতাকর্মীর জন্য তাদের সমর্থকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, সমাবেশ ও স্বাধীনভাবে প্রচার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল।
রাজনৈতিক পরিবেশ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাত ও ধর্মঘটকে আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। দেশে আওয়ামী লীগের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর দমন-পীড়নের প্রেক্ষাপটে এখন সংঘাত ও ধর্মঘট কমেছে। তবে দৃশ্যত একদলীয় রাষ্ট্র হওয়ার পথে হাঁটা এবং বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকে কোণঠাসা করার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে নাগরিক সমাজের অনেক সংগঠন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রম অধিকার ও কারখানা সুরক্ষা বিষয়ক সমস্যাগুলো অর্থবহভাবে নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় বাংলাদেশ অগ্নিনিরাপত্তা ও কর্মক্ষেত্রের সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। তবে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকাগুলোসহ (ইপিজেড) কর্মীদের সমবেত হওয়া ও দর-কষাকষি করার অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি আছে। এ ছাড়া মেধাস্বত্ব সুরক্ষার দিক দিয়েও বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে আছে।