ইউক্রেনের পতাকায় নীল-হলুদ রঙ দেশটির মেঘহীন আকাশের নিচে গমের প্রাচুর্যের প্রতীক। কিন্তু সেই আকাশ আজ গাঢ় ধোঁয়ায় ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে। ট্রাক্টরগুলোতে এখন শস্য নয়, আনা-নেওয়া হচ্ছে যুদ্ধের সরঞ্জাম। আর রুশ নৌবাহিনীর অবরোধে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না ইউক্রেনের উৎপাদিত শস্যগুলো। যুদ্ধের প্রভাবে এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি সতর্ক করেছে, এতে অন্তত ৪ কোটি ৭০ লাখ মানুষ তীব্র ক্ষুধার ঝুঁকিতে পড়েছে।
ইউক্রেনের শস্য রেলপথে বিদেশে পাঠানো কঠিন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যদি তারা এভাবে বিচ্ছিন্নই থাকে, তাহলে বিশ্ববাসীর চাহিদা মেটাতে অন্য অঞ্চলগুলোতে শস্য উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে।
তবে বাস্তবতা বলছে, বিশ্বের সব মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটানোর মতো শস্য এরই মধ্যে উৎপাদন হয়েই রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, এর ৪৩ শতাংশ হয় জৈব জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হবে নাহয় পশুপাখির পেটে যাবে এবং এর পরিমাণ হবে রাশিয়া-ইউক্রেনে উৎপাদিত শস্যের প্রায় ছয়গুণ বেশি।
বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত শস্যের অর্ধেকেরও কম যায় মানুষের পেটে
বিশ্বে উৎপাদিত মোট শস্যের অর্ধেকেরও কম মানুষের পেটে যায়। যেমন- গমের কথাই ধরা যাক। রাশিয়া-ইউক্রেনে উৎপাদিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য এটি। সবশেষ ২০১৯ সালে পাওয়া তথ্য বলছে, ওই বছর বর্তমানে যুদ্ধরত দেশ দুটিতে গম উৎপাদন হয়েছিল মোট ১০ কোটি ৩০ লাখ টন। অথচ একই বছর বিশ্বজুড়ে পশুপাখির খাদ্য হয়েছিল অন্তত ১২ কোটি ৯০ লাখ টন গম, আরও ২ কোটি ২০ লাখ টন ব্যবহৃত হয়েছিল জৈব জ্বালানি তৈরিতে।
রাশিয়া-ইউক্রেনের দ্বিতীয় প্রধান শস্য ভুট্টা মানুষের খাবার প্লেটে ওঠে আরও কম। বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত ভুট্টার মাত্র ১৩ শতাংশ খায় মানুষ। তার ওপর দেশ দুটিতে চাল উৎপাদন একেবারে সামান্য হওয়ায় তাদের উৎপাদিত শস্যে মানুষের ক্ষুধা নিবারণের হার মাত্র ৩৭ শতাংশ, যা বৈশ্বিক গড় ৪৬ শতাংশেরও কম।
২০১০-এর দশকে বিশ্বে জনসংখ্যা যে হারে বেড়েছে, তারচেয়েও দ্রুত বেড়েছে শস্য উৎপাদন। ওই বছরগুলোতে বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১১ শতাংশ, সেই তুলনায় শস্য উৎপাদন বেড়েছে অন্তত ১৭ শতাংশ। এসময় অনেকে অভুক্ত থাকলেও মানুষের মাথাপিছু খাদ্যগ্রহণের হার ছিল প্রায় অপরিবর্তিত। ফলে বাড়তি শস্যগুলো ব্যবহৃত হয়েছে অন্য কাজে। ১০ ভাগের প্রায় নয়ভাগ রূপান্তরিত হয়েছে জৈব জ্বালানিতে (যা প্রধানত যানবাহনে ব্যবহৃত হয়), তবে সিংহভাগই গেছে পশুপাখির পেটে।
দ্য ইকোনমিস্টের হিসাবে, বিশ্বে শূকরের মোট সংখ্যা যদি কোনো একটি দেশের জনসংখ্যা হতো, তবে সেটিই হতো শস্যের এক নম্বর ভোক্তা। এরা যে পরিমাণ শস্য খাবার হিসেবে গ্রহণ করে, তা দিয়ে বিশ্বের ২০০ কোটি মানুষের ক্ষুধা নিবারণ সম্ভব।
২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত শস্যের পরিমাণ বছরে ৭৭ কোটি টন থেকে বেড়ে ৯৮ কোটি ৭০ লাখ টনে পৌঁছেছে। এই সময়ে বিশ্বে চারণভূমি কমলেও মাংসের প্রতি মানুষের আগ্রহ অনেক বাড়তে দেখা গেছে।
ভুট্টার ভূসির মতো শস্যজাত কিছু জিনিস মানুষের খাবারের উপযোগী নয়। এগুলো পশুপাখিকে খাওয়ানোর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে মানুষেরই খাদ্য উপাদন হয়; যেমন- দুধ, ডিম, মাংস। তবে এই প্রক্রিয়াটিও অত্যন্ত অপচয়কারী। একটি গরুকে প্রতি ১০০ ক্যালরির শস্য খাওয়ালে মাত্র তিন ক্যালোরির মাংস পাওয়া যায়। তাছাড়া এদের জন্য নানা খাদ্যশস্য উৎপাদন ও চারণভূমির পাশাপাশি লালন-পালনে যে জমি ব্যবহৃত হয়, সেখানে মানুষের জন্যই খাদ্যশস্য উৎপাদন করা যেতো।
বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত শস্যের অর্ধেকেরও কম যায় মানুষের পেটে
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে অধিক পরিমাণ শস্যকে খাদ্যে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জার্মানি ও বেলজিয়াম জৈব জ্বালানি নীতির বাধ্যবাধকতা শিথিল করতে পারে। চীন এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, তারা ভুট্টাকে ইথানলে রূপান্তর ‘কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ’ করবে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বাড়তে থাকায় চলতি বছরের মধ্যে জৈব জ্বালানির চাহিদা আরও পাঁচ শতাংশ বাড়বে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ)।
এ অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি সংকট সমাধানের একমাত্র উপায়- নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো। তবে আপাতত অপচয় কমানো এবং পশুখাদ্যের পরিবর্তে গম-ভুট্টাকে মনুষ্য খাদ্যে পরিণত করাই সম্ভবত সেরা প্রতিকার। মজার বিষয় হলো, বিশ্বের শস্যঘাটতি দূর করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো- মানুষকে আরও বেশি করে শস্য খেতে হবে, কমাতে হবে মাংস খাওয়া।