ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বিস্ফোরিত সাগর নন্দিনী-২ জাহাজে দ্বিতীয়বার বিস্ফোরণের ১১ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার ভোর ৫টা ২০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্য দগ্ধ হন। এছাড়া নদীতে লাফিয়ে পড়ে আহত হন ১০ পুলিশসহ আরো ১৪ জন।
সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিস্ফোরণ হওয়ার পর জাহাজটিতে আবারো আগুন লাগে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতার জন্য যুক্ত হয় কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মীরা।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, জাহাজের স্টাফদের অসচেতনতা, অদক্ষতা ও বিচক্ষণতার অভাবেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকা-ের ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আন্ত:মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসক এবং ফায়ার সার্ভিস এই কমিটি গঠন করে।
ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা জানান, সাগর নন্দিনী-২ এর জ¦ালানি তেল খালাসের সময় সাবমারসেবল পাম্প প্রচন্ড তাপে বিস্ফোরিত হয়ে পুরো জাহাজে আগুন লেগে যায়। ঢাকা থেকে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল রাতেই ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফোম দিয়ে রাতভর চেষ্টার পর ভোরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
বিস্ফোরণে দগ্ধ পুলিশের দুই কনস্টেবলকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনা বার্ন ইনিস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। আহত অন্যদের ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।
এদিকে বিস্ফোরণের পর রাতভর আতঙ্কে ছিলেন সুগন্ধা নদীতীরের বাসিন্দারা।
স্থানীয়রা জানান, শহরের মধ্যেই সুগন্ধা নদীর তীরে পদ্মা ও মেঘনা কোম্পানির দুটি ডিপো রয়েছে। এতে প্রতিদিন পাঁচ-ছয়টি জাহাজ নোঙর করে জ¦ালানি তেল খালাস করে। নদীতে এভাবে একের পর এক অগ্নিকা-ের ঘটনায় ক্ষুব্ধ শহরবাসী। সুগন্ধা নদীতীরে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন নৌ ফায়ার স্টশন স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। শহরের মধ্য থেকে তেলের ডিপো সরিয়ে নেওয়া এবং নদীতে তেলবাহী একাধিক জাহাজ নোঙর করে না রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শহরের বাসিন্দারা। শহর সুরক্ষিত রাখতে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন নৌ ফায়ার স্টেশনেরও দাবি জানান তাঁরা।
ঝালকাঠির বাসিন্দা প্রশান্ত দাস বলেন, এখন নদীতে প্রায়ই জাহাজ ও লঞ্চে আগুন লেগে প্রাণহানি ঘটে। আমাদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। নদীর তীরের মানুষ রাতে ঘরে ঘুমাতে পারে না। আতঙ্কে অনেকেই বাড়িঘর ছেড়েছে। আমরা এ থেকে পরিত্রাণ চাই।
স্বেচ্ছাসেবী শাকিল হাওলাদার রনি বলেন, জাহাজে বিস্ফোরণের সময় পুরো শহর প্রকম্পিত হয়ে যায়। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে যে যার মতো করে ছোটাছুটি করে। আমরা সবাইকে ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানিয়েছি। চর এলাকার মানুষ রাতে ঘুমাতে পারেনি। আমাদের দাবি একটাই, নদী পথকে নিরাপদ রাখতে হবে।
কোস্টগার্ডের অপারেশন কর্মকর্তা ল্যাফটেনেন্ট শাফায়েত বলেন, দ্বিতীয় দফায় বিস্ফোরণের সময় কোস্টগার্ডের একটি জাহাজ ঘটনাস্থলে ছিল। বিস্ফোরণ এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে ১০০ মিটারের মধ্যে কোন উদ্ধাকারী দল পৌঁছতে পারছিল না। জ¦ালানি তেল ছড়িয়ে পড়া রোধে কাজ করেছে কোস্টগার্ড।
এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঝালকাঠি-২ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। দুর্ঘটনায় আহত সদর হাসপাতালে ভর্তি পুলিশ সদস্যদের দেখতে যান তিনি। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে জাহাজে বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল দুপুরে পরিদর্শন করেছেন জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ডক্টর খায়েরুজ্জামান মজুমদার। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার আমিন উল আহসান, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল খালেক মল্লিক, ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম ও পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী আরো বলেন, জাহাজে দক্ষকর্মী নিয়োগ দিতে জাহাজ কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। বর্তমানে ঝালকাঠির নৌরুট নিরাপদ রয়েছে। জাহাজটিতে এখনো পেট্রোল রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই তেল খালাস করার চেষ্টা করা হবে।
জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ডক্টর খায়েরুজ্জামান মজুমদার জানান, জাহাজে বিস্ফারণের ঘটনায় বিস্ফোরক অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে প্রধান করে আন্ত মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও আরো দুটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। জেলা প্রশাসক সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবেন। এ ঘটনায় যদি কারো দায়িত্বে অবহেলা থেকে থাকে, তদন্ত কমিটি রিপোর্ট করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভোলার কাঠিরমাথা নামক এলাকায় তুলাতলী নদীতে সাগর নন্দিনী-৩ চলন্ত অবস্থায় ডুবে যায়। তখন বেশ কয়েকজন আহত হয়। এছাড়া ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর একই স্থানে একই কোম্পানির জাহাজ সাগর নন্দিনী-৩ বিস্ফোরণে ৫ জন নিহত হন।