খুলনা প্রতিনিধি//জান্নাতুল ফেরদৌস:
আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে খুলনার নদী ও খাল অবৈধ দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হচ্ছে। গতকাল বুধবার উচ্ছেদ অভিযানের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জেলা প্রশাসক মোঃ হেলাল হোসেন। সেখানে ময়ূর নদী থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে ময়ূর নদী ও সংলগ্ন ২৬টি খাল এলাকা থেকে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে মাইকিং করছে জেলা প্রশাসন। গত শনিবার থেকে এই মাইকিং শুরু হয়। যা’ এখনও চলছে। অপরদিকে খুলনা নদীবন্দর থেকে লবণচরা পর্যন্ত ভৈরব ও রূপসা পাড়ের ১ হাজার ১৫৪টি অবৈধ স্থাপনা নিজ উদ্যোগে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। গত ২৬ ও ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মচারীরা ব্যবসায়ীদের কাছে এই নোটিশ পৌঁছে দিয়েছে। তবে ব্যবসায়ীররা অভিযোগ করেছেন, খুলনা ভৈরব নদের বড় বাজার এলাকায় নদীর সীমানা চিহ্নিত না করেই গণহারে ব্যবসায়ীদের নোটিশ পাঠানো হয়েছে। বাজারের ভেতরে ব্যক্তি মালিকানা জায়গার স্থাপনা এবং নদীর সীমানার বাইরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এনিয়ে বড়বাজার এলাকায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে গতকাল সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের কাছে যান ব্যবসায়ীরা। সিটি মেয়র নদীর সীমানা চিহ্নিত করে দিতে বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ভৈরব নদের খুলনা নদী বন্দর থেকে রূপসা ফেরীঘাট পর্যন্ত এবং ফেরিঘাট থেকে রূপসা নদীর রূপসা সেতু এলাকায় জরিপ চালায় বিআইডব্লিউটিএ। সেখানে নদী দখল করে তৈরি করা ১ হাজার ১৫৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করা হয়। আর ময়ূর নদী ও ২৬টি খালে যৌথ জরিপ চালায় জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে সরকারের ৪টি সংস্থা। এর মধ্যে সেখানে ৪৬০ জন দখলদারের তালিকা তৈরি করা হয়। নদী ও খাল দখল করে তৈরি স্থাপনার সংখ্যা ৩৮২টি। এর মধ্যে ময়ূর নদে ৭৯ জন ব্যক্তি ৬৩টি অবৈধ স্থাপনা তৈরি করেছেন বলে জরিপে উঠে আসে। সূত্রটি জানায়, গতকাল বুধবার কেসিসির ৭ম সাধারণ সভায় খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদের বিষয়ে কাউন্সিলরদের সহযোগিতা কামনা করেন সিটি মেয়র। দুপুরে নগর ভবনে আসেন নদী ও খালের উচ্ছেদ কমিটির আহ্বায়ক ও জেলা প্রশাসক মোঃ হেলাল হোসেন। সেখানে ১ সেপ্টেম্বর থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক নদী ও খাল উচ্ছেদ তদারকি কমিটির প্রধান উপদেষ্টা। এ ব্যাপারে সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা জন ও যান চলাচলে দুর্ভোগ সৃষ্টির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সড়কসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টির যে সকল কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম মহানগরীর অভ্যন্তরীণ ও পার্শ্ববর্তী নদী ও খালসমূহ অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়া। এসব খালের দখলদারদের তালিকা তৈরি করেছে জেলা প্রশাসন। সেপ্টেম্বর মাসে একযোগে অভিযান শুরু হবে। খালের ওপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন সিটি মেয়র। ॥ বড় বাজারের ব্যবসায়ীরা আতংকে ॥ খুলনা ভৈরব নদের বড় বাজার এলাকায় নদীর সীমানা চিহ্নিত না করেই গণহারে ব্যবসায়ীদের নোটিশ পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, নদীর সীমানা চিহ্নিত করতে গিয়ে বিআইডব্লিউটিএ কোনো নিয়মই মানেনি। হাইকোর্ট সিএস ম্যাপ অনুযায়ী নদী জরিপ করতে বললেও তারা তাদের ইচ্ছামতো সীমানা নির্ধারণ করেছে। বাজারের এলাকায় কোন পিলার স্থাপন করেনি। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের দোকানসহ অন্যান্য স্থাপনা নদীর ভেতরে দেখানো হয়েছে। এছাড়া নদীর সীমানা, শহররক্ষা বাঁধ, ভৈরব স্ট্যান্ড সড়ক নিয়ে খুলনার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো ১৯৯৬ সালে একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্তে পৌঁছালেও এর কোনোটিই বিআইডব্লিউটিএ মানেনি। বিআইডব্লিউটিএ থেকে জানা গেছে, ভৈরব নদের সীমানা চিহ্নিত করতে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যৌথ জরিপ শুরু করেন তারা। গত জুন মাস পর্যন্ত নদীর বানিয়াখামার, হেলাতলা, টুটপাড়া ও লবণচরা মৌজা এলাকার ৫ কিলোমিটার এলাকার জরিপ কাজ শেষ হয়েছে। নদীর তীরে ১ হাজার ১৫৪টি অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরি করেছেন তারা। এর মধ্যে খুলনা নদীবন্দর থেকে কালিবাড়ি ঘাট পর্যন্ত বড় বাজার অংশে স্থাপনা রয়েছে ১৫৪টি। অন্য অংশে স্থায়ী কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। নদীর চরে ডকইয়ার্ড, ফাঁকা অংশে গোডাউন, স’মিল, কয়লা-পাথর-ইট-বালুর গোলা, সেমিপাকা ঘর রয়েছে। ইতোপূর্বে তাদের ব্যবসার জন্য লাইসেন্স প্রদান করা হলেও সেটি বাতিল করা হয়েছে। তবে বড় বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, ব্যবসায়ীরা নদী দখল করেনি। বরং ব্যবসায়ীদের ঘরবাড়ি, স্থাপনা নদী কেড়ে নিয়েছে। সিএস ম্যাপ অনুযায়ী নদী জরিপ হলে তাদের জমি তারা ফেরত পাবেন। বর্তমানে নদী থেকে ৩০/৪০ ফুটের দূরের স্থাপনাও সরিয়ে নেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। গতকাল বুধবার বিকালে সরেজমিন নদী এলাকায় গিয়ে কোনো সীমানা পিলার দেখা যায়নি। নদী থেকে প্রায় ৩০ ফুট দূরের পাকা স্থাপনাও উচ্ছেদ করার নোটিশ দেখা গেছে। কিসের ভিত্তিতে অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরি করা হয়েছে বা নদী থেকে কতোদূর পর্যন্ত স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে-তার কোনো চিহ্ন ওই এলাকায় দেখা যায়নি। বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে ভৈরবপাড়ে ব্যবসা শুরু করেন তাদের বাবা ও দাদারা। ভৈরব স্ট্র্যান্ড রোড ঘিরেই ওই এলাকায় জনবসতি গড়ে ওঠে। এই বড়বাজার ঘিরেই দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ হতে থাকে। ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৫০-৫৫ সালে ভৈরব নদের পাড়ে অনেক পাকা স্থাপনা ছিলো। কিন্তু ষাটের দশক থেকে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। আশির দশকের মধ্যেই বেশিরভাগ স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তখন নদীর পাড়ে কেউ পাকা দোকান ঘর তুলে, কেউ অস্থায়ী ঘর তৈরি করে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত রাখেন। পরবর্তীতে বিআইডব্লিউটিএ’র কাছ থেকে এসব জমি তারা বন্দোবস্ত নিয়ে ব্যবসা করছেন। বড় বাজারের খুলনা ট্রেডিংয়ের মালিক অহিদুর রহমান বলেন, ১৯৫০ সালে আমার দাদা ভৈরব তীরে জমি কিনে ভবন তৈরি করেন। সেই দলিল এখনও আমাদের কাছে রয়েছে। পরবর্তীতে নদী ভাঙতে ভাঙতে প্রায় ২০ ফুট ভেতরে ঢুকে গেছে। তখন আমাদের জায়গাতেই অস্থায়ী ঘর তৈরি করেছি। সিএস ম্যাপ অনুযায়ী সীমানা চিহ্নিত করলে আমাদের কেউ নদী দখলদার বলতে পারবে না। অথচ আমাকে স্থাপনা ছাড়ার নোটিশ দেয়া হয়েছে। যশোর ট্রেডিংয়ের দীনেশ চন্দ্র দাশ বলেন, আমাদের ঠাকুর দাদার সময় থেকে বাজারে ব্যবসা। আমার বাবা ৪০ বছর, আমি নিজে ৪৫ বছর ধরে ব্যবসা করছি। নদীর ভেতরে আমাদের একতলা ভবন ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের কয়েকবছর পরে সেটা ভেঙ্গে যায়। এখনও জমির দলিল আমাদের কাছে আছে। নিজ জমিতে ব্যবসা করেও এখন আমাদের দখলদার বলা হচ্ছে। বড় বাজার ধান-চাল বণিক সমিতির সহ-সভাপতি তাজুল ইসলাম পাটোয়ারি বলেন, চালপট্টির কাছে মাজেদ সাহেবের ঘরটি এক সময় ৩ তলা ভবন ছিলো। সেখানে রেস্টুরেন্ট ছিলো। কলেজ জীবনে আমরা রেস্টুরেন্টে খেয়ে তৃতীয় তলায় গিয়ে বিশ্রাম নিতাম। পরে ভবনটি নদীতে ভেঙ্গে যায়। এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। এসব স্থাপনাকেও এখন অবৈধ বলা হচ্ছে। বড় বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ীরা জানান, এক সময় ব্যবসায়ীদের ঘর ছিলো ৪০ ফুট লম্বা। তখন খুলনা শহররক্ষা বাঁধ ছিলো না। শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা ২০ ফুট করে জমি ছেড়ে দিয়েছিলো। তখনকার খুলনার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা লিখিত অঙ্গীকার করেছিলো নদীর পাড় থেকে ব্যবসায়ীদের কোনোভাবেই উচ্ছেদ করা হবে না। সেই কাগজ এখনও আমাদের কাছে রয়েছে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা এস এম এ রব, মঞ্জুরুল ইমাম, বিএনপির দাদু ভাই, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, অ্যাডভোকেট ফিরোজসহ অনেকেই তাতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু কেউ সেই কথা রাখছেন না। বাজার কমিটির উপদেষ্টা ও খুলনা চেম্বারের সিনিয়র সহ-সভাপতি শেখ আসাদুর রহমান বলেন, খুলনা শহর গড়ে উঠেছে বড় বাজারের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। এখন হঠাৎ করে তাদের উচ্ছেদ করা হলে-এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু থাকবে না। এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ খুলনার উপ-পরিচালক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অল্পকিছু দিনের মধ্যেই জেলা প্রশাসনের ও আমাদের সার্ভেয়ার নিয়ে নদীর সীমানা চিহ্নিত করে দেয়া হবে। এরপর তাদের নিজ দায়িত্বে স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলা হবে।