সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ‘মিড-ডে মিল’ (দুপুরের খাবার) চালু করতে যাচ্ছে। ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের একবেলা খাবার খাওয়ানোর লক্ষ্য নিয়ে ‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি-২০১৯’ এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নীতিমালা অনুযায়ী প্রাথমিকের প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থীকে একবেলা খাবার দেয়া হবে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ সংক্রান্ত নীতিমালার খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. শফিউল আলম।
তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি ও ঝরে পড়া হ্রাস করতে সারা বছর পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার দিতে এ নীতিমালার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এ নীতিমালা অনুসারে শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে পাঁচদিন গরম খাবার ও একদিন পুষ্টিকর বিস্কুট দেয়া হবে।’
একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য, সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার’ দিতেই এই উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। অথচ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হওয়া উচিত মানসম্পন্ন শিক্ষার বাতিঘর।
দেশে খাদ্যের অভাব আছে, এমন তথ্য সাম্প্রতিককালে কারো জানা নেই। স্কুলগামী শিশুরা না খেয়ে পড়তে যায়, বিষয়টি এমনও নয়। তাছাড়া, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দুই শিফটে চলে। এর প্রথমটি চলে দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত, দ্বিতীয়টি বারোটা থেকে চারটা পর্যন্ত। দুটি শিফটের মধ্যবর্তী সময় দুপুর বারোটা। নিশ্চিতভাবেই এই সময়টা ‘মিড-ডে মিল’ গ্রহণের সময়।
কিন্তু, প্রথম শিফট যখন শেষ হয়, বাচ্চারা যার যার বাড়ি ফিরে গিয়েই দুপুরের খাবার খেতে পারে। অপরদিকে দ্বিতীয় শিফটের অপেক্ষাকৃত বড় বাচ্চারা বারোটার দিকে বাড়ি থেকে খেয়েই বিদ্যালয়ে আসে। স্কুল কর্তৃক সরবরাহকৃত একটি বিস্কুটের প্যাকেট দিয়েই বাকি সময়টুকু স্কুলে নির্ধারিত সময় পার করতে পারবে বলে মনে হয়।
এখন মিড-ডে মিল চালু হলে দুই শিফটের মধ্যবর্তী সময়ে খাওয়া-দাওয়ার বিশাল আয়োজন হবে। ছয়-সাতশো ছেলেমেয়ের খাওয়ার আয়োজনটি একটি হুলস্থূল কাণ্ডে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিদিন কয়েকশো ছেলেমেয়ের খাওয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে উভয় শিফটের ক্লাসগুলো সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা শিক্ষকদের জন্য সহজ নাও হতে পারে।
এমনিতেই বর্তমানে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথেষ্ট। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেকটাই কমে এসেছে। নির্ধারিত ক্যাচমেন্ট এরিয়ার শিক্ষার্থী দিয়েই প্রতিটি ক্লাসরুম পরিপূর্ণ থাকে। এদেরকে ধরে রাখার জন্য প্রতিটি স্কুলের ভৌত অবকাঠামোর আধুনিকায়নসহ আনন্দদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করাটাই সময়ের সবচেয়ে শ্রেষ্ট চাহিদা। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনন্দঘন পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মনে রাখা প্রয়োজন, প্রলোভন দেখিয়ে আর যাই হোক, পাঠদান হয় না।
ইতিমধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সাথে দেশের মেধাবী তরুণ প্রজন্ম যুক্ত হচ্ছে। এটা অবশ্যই আশার কথা। তবে হতাশার কথা হল, অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঠিকমত পাঠদান হয় না, হচ্ছে না। যেনতেনভাবে আয়োজিত পিইসি নামের পরীক্ষার রেজাল্টের যে চিত্র আমরা প্রতিবছর দেখি, তার সাথে বাস্তবতার ফারাক অনেক বেশিই থাকে।
সরকার কোয়ালিটি এডুকেশন চায়। এ জন্য শিক্ষাখাতে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। দেখার বিষয় হল, সাধারণ মানুষের করের টাকায় বাজেটে বরাদ্দকৃত টাকা সঠিক উদ্দেশ্যে ঠিকমত ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা।
বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ। ভাতের অভাবে দিন কাটায় এমন পরিবার আছে বলে মনে হয় না। তাই, ‘মিড ডে মিল’ প্রকল্পটি শিক্ষার মানোন্নয়নে কী ভূমিকা রাখবে তা কিন্তু অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। তার চেয়ে বরং সব শিক্ষার্থীর ইউনিফরম ও খাতা কলম খরচের পুরোটা সরকার বহন করলে এর কার্যকারিতা বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে। মিড ডে মিল প্রকল্পের চেয়ে এক্ষেত্রে খরচের হারও কম হতে পারে।
দরকার, সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। তৃতীয় পক্ষের কারো পকেট যাতে ভারি না হয়, সেই দিকটায় নজরদারিটাই যে কোন প্রকল্প সফল হওয়ার মূল কারণ। আমাদের ঘাটতি এখানেই প্রবল।