কেউ কথা কইয়েন না, একটু চা খাব? খাই একটু? আপনারা খাবেন? ঢেলে দেই? (মুচকি হেসে আবারও) ঢেলে দেই? … ‘ভাই পরিবেশটা সুন্দর না? কোনো হইচই আছে? আমি কি কাউকে গালি দিয়েছি? কারোর বিরুদ্ধে বলতেছি? এরপরও সকালে একদল লোক বলবে, তাহেরী বালা (ভালো) না।’
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বক্তব্যের ভিডিওগুলো রীতিমতো ভাইরাল।
চলতি মাসের ১৮ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত গুগলে ‘ঢেলে দেই’ শব্দ দুটি সার্চ করেছেন প্রায় শতভাগ বাংলাদেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত-সমালোচিত এ শব্দ দুটির বক্তা মুফতি গিয়াস উদ্দিন আত-তাহেরী।
তবে তাহেরী বললেন ভিন্ন কথা। বলেন, ‘হিংসা-প্রতিহিংসা থেকে অনেকে আমার বক্তব্য কাট করে ট্রল করছে’।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার অশ্লীল আচারভঙ্গি নিয়ে সমালোচনার জবাবে তাহেরী বলেন, ‘ওয়াজ মাহফিল নিয়ে সমালোচনা দু-একজন করতেই পারেন। কিন্তু আমার গ্রহণযোগ্য আলোচনার বিষয়গুলো নিয়েই তো আপনারা প্রচার করবেন। যারা ওয়াজ মাহফিল থেকে শব্দ কাট করে আমাকে সমালোচনার পাত্র হওয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন, আপনারা তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যান।’
ওয়াজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজরদারির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে কাউকে নজরদারিতে রাখতে পারে। এতে আমি বিচলিত নই।’
তার কয়েকটি ওয়াজের ভিডিওতে অশ্লীল আচারণভঙ্গি, জিকিরের মাঝে গান-নাচ থাকা নিয়েও সমালোচনা হয়। গত বছরের মাঝামাঝি এক ওয়াজ মাহফিলে জিকিরের সময়, ‘বসেন বসেন, বসে যান’ উদ্ধৃতিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হয়।
সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের একটি জেলায় ওয়াজ মাহফিলে কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমের ‘পোলাতো নয় সে যে আগুনের গোলা রে’ গানটি নেচে-গেয়ে উপস্থাপন করায় ইসলামী আলোচকদের সমালোচনার মুখে পড়েন তাহেরী।
ওয়াজ মাহফিলে নাচ ও গানের বিষয়ে ওই সময় তিনি বলেন, ‘এটা গান না। এগুলো করে আমি পোলাপাইনদের কৌশলে লাইনে আনি।’
ওয়াজে অশ্লীলতা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক ও আইসিটি) আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, যেকোনো ওয়াজ ও ওয়াজের বক্তাকে আমরা নিয়মিত ফলোআপ করি। আমাদের সাইবার সেল এ নিয়ে কাজ করছে। তারা রিপোর্ট করলে তার (তাহেরী) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দাওয়াতে ঈমানী বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মুফতী মুহম্মদ গিয়াস উদ্দিন আত তাহেরী। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জিকিরের সময় নেচে-গেয়ে ‘বসেন বসেন, বইসা যান’ বলায় সমালোচিত হন তাহেরী। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে নিয়ে তৈরি হয় নানা ট্রল ও ভিডিও। এরপর কিছুদিন ওয়াজ বন্ধ রেখেছিলেন তিনি। সম্প্রতি ফের আলোচনায় এলেন এই বক্তা। কিন্তু কে এই তাহেরী? তার পরিচয়ই বা কি?
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেন মুফতী মুহম্মদ গিয়াস উদ্দিন আত তাহেরী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাহেরী নামেই তিনি পরিচিত। তার পারিবারিক ইতিহাস ও বংশগত পরিচয় নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে তিনি তর্ক বিতর্কের মধ্য দিয়েই যাচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে। যদিও তিনি তার সম্পর্কে বিতর্কের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে আসছেন। তার বিরুদ্ধে নাচ করার যে অভিযোগ রয়েছে তাকে তিনি ক্যামেরার কারসাজি বলে উল্লেখ করেছেন।
স্থানীয়দের মধ্যে তাহেরীকে নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। গিয়াস উদ্দিন আত তাহেরী একজন লাল পাগড়ি ও লাল আলখেল্লা পরিহিত পীর। রায়পুরার মাস্তানগঞ্জ নামক একটি মহল্লায় খাজা বাবার দরবার নাম দিয়ে এখানে দীর্ঘদিন ধরে একটি আস্তানা গড়ে তুলেছেন তিনি। এ আস্তানায় সার্বক্ষণিক বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের আড্ডা চলে। নারী পুরুষের একত্রে নাচানাচি করার অভিযোগও রয়েছে এই আস্তানায়। তবে ঘটনার সত্যতা কতটুকু বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
২০১৩ সালে নরসিংদীতে গিয়াস উদ্দিন আত-তাহেরীর ওয়াজে তাবলীগের লোকদের কাফের বলে গালাগাল, আলেম-ওলামা সম্পর্কে এবং শরীয়তের পীর-মাশায়েকদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য নিয়ে রায়পুরার অলিপুরা শাহেরচর ও বড়চর গ্রামে ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ অর্ধশত শটগানের ফাঁকা গুলি ও ৩০ রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। ওই ঘটনায় একটি মামলাও হয়।
গণমাধ্যমগুলো বলছে, গিয়াস উদ্দিন আত তাহেরী তার বক্তৃতায় তাবলীগের লোকদের কাফের বলে গালাগাল করে এবং আলেম ওলামা সম্পর্কে ও শরীয়তের পীর মাশায়েকদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে। গত ১৫ জানুয়ারি নরসিংদীতে স্থানীয় ছাদেক চেয়ারম্যান ও এলাহী মেম্বার মিলে অলিপুরা গ্রামে গিয়াস উদ্দিন আত তাহেরীকে প্রধান বক্তা করে এক জলসার ঘোষণা দিলে এলাকার লোকজনের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারা আত তাহেরীর আগমন বন্দের দাবিতে মিছিল করে রায়পুরা প্রধান সড়কে অবস্থান নেয়।
গত ২৫ আগস্ট কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আল্লামা শাইখ নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যার বিচারের দাবিতে ভৈরবে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করে সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা। এই মানববন্ধনেই সর্বশেষ অংশ নিতে দেখা যায় তাহেরীকে।