ডিজিটাল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে সাবেক সেনা সদস্যসহ বিভিন্ন পেশার বেশ কয়েকজনকে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সরকারকে উত্খাত করতে একটি শক্তিশালী ফেসবুক গ্রুপ গড়ে তুলে ষড়যন্ত্রের ছক আঁকছিলেন।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত সরকারবিরোধী প্রতিক্রিয়া ও বিদ্বেষপূর্ণ মতামত এবং সিক্রেট চ্যাটিংয়ের তথ্য অনুসন্ধানের সূত্র ধরে আনিসুর রহমান চৌধুরী (৪১) নামের এক ব্যবসায়ীকে গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছিল। আনিসুরের সরকারবিরোধী অপতৎপরতার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর গত ২৩ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলে আনিসুর রহমান জানান, তিনি সামরিক বাহিনীতে একসময় সৈনিক পদে চাকরি করতেন। বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হওয়ার পর তিনি ঢাকায় একটি বিদেশি দূতাবাসে যাতায়াত শুরু করেন। একপর্যায়ে ফেসবুকের সূত্র ধরে তার সঙ্গে র্যাব-৭-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল (চাকরিচ্যুত) হাসিনুর রহমানের পরিচয় হয়। হাসিনুর তাকে সরকারবিরোধী মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশে উৎসাহিত করতেন। তার একেকটি সরকারবিরোধী প্রতিক্রিয়া ব্যাপকভাবে লাইক শেয়ার দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। এভাবেই তারা একটি সরকারবিরোধী শক্তিশালী ফেসবুক গ্রুপ গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে ধীরে ধীরে তারা সরকার উত্খাতের ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের পথে পা বাড়ান। গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতে হাজির হয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত স্বীকার করেন আনিসুর রহমান চৌধুরী। সেখানে তিনি বলেন, ২০১৪ সালে মোহাম্মদপুরের জনৈক রাজনৈতিক নেতা ইব্রাহিম খলিল ওরফে বাবু মিশুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে বাবু মিশু তার মামা হিসেবে জনৈক ইকবাল চৌধুরীর সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। এই বাবু মিশু প্রায়ই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বঙ্গভবনসহ বিভিন্ন দূতাবাসে যাতায়াত করেন। তিনিই চৌধুরী আনিস নামে তাকে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেন। এ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তিনি সরকারবিরোধী বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতেন। একপর্যায়ে বাবু মিশু ও ইকবাল চৌধুরী ডা. সেলিম নামের আরেক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন। ডা. সেলিম আগে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা বলে পরিচয় দেন। এদিকে গাড়ি ব্যবসার সূত্রে আনিসুর রহমান চট্টগ্রামে যাতায়াত করতেন। তখন তার সঙ্গে র্যাব-৭-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল হাসিনের সখ্য গড়ে ওঠে। হাসিন তার ফেসবুক ফ্রেন্ড ছিলেন। ফেসবুকে সরকারবিরোধী কোনো মন্তব্য করতে হাসিন তাকে উৎসাহিত করতেন। এভাবে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শের মিল থেকে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। আনিসুর রহমানের জবানবন্দিতে আরও বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। তারা হলেন ক্যাপ্টেন (অব.) মারুফ রাজু (নেভি), ক্যাপ্টেন (অব.) গনিউল আজম (নেভি), মেজর (অব.) ফেরদৌস, স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) ওয়াহিদুন নবী, ক্যাপ্টেন (অব.) আইয়ুব হোসেন, লে. কর্নেল (অব.) ফেসদৌস আজিজ ও লে. কর্নেল (অব.) তৌহিদ। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন গনিউল আজম ও লে. কর্নেল তৌহিদ খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দল সিএসএফের সদস্য। ক্যাপ্টেন মারুফও একসময় সিএসএফে ছিলেন। এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলেন বিডি পলিটিকো নামের একটি রাজনৈতিক ওয়েবসাইটের পরিচালক কামরুল ইসলাম। চলতি বছরের এপ্রিলে ইকবাল চৌধুরীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকারকে উচ্ছেদের জন্য সামরিক, বেসামরিক ও অবসরপ্রাপ্তদের নিয়ে ৭০ জনের একটি টিম গঠনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে আনিসুর রহমান চৌধুরী জানান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তিনি সৈনিক পদে চাকরি করতেন। কিডনি জটিলতার কারণে ২০০১ সালের এপ্রিলে তিনি মেডিকেল বোর্ড কর্তৃক আউট হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন। এর মধ্যে মারুফ রাজু ওরফে রানা বিএনপির পক্ষে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকের নামে ভুয়া বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে আলোচনায় আসেন। সর্বশেষ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক নিশা দেশাই ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারির ছবিসংবলিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছিলেন; যা পরে ভুয়া প্রমাণিত হয়। এ ঘটনার পর থেকেই তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। এ ছাড়া গত ৭ মে থেকে নিখোঁজ রয়েছেন ইকবাল চৌধুরীও। র্যাব-৭-এর অধিনায়ক (সিও) হিসেবে কর্মরত থাকার সময় লে. কর্নেল হাসিনুরের বিরুদ্ধে জঙ্গিসম্পৃক্ততার অভিযোগ আসে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা। তদন্তে প্রমাণিত হয়, হাসিনুরের সঙ্গে হিযবুতের প্রধান সংগঠক মহিউদ্দীনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তদন্তে উঠে আসে র্যাব-৭-এর কার্যালয়ে বসে তিনি হিযবুত নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। হিযবুত নেতা মহিউদ্দীন গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে হাসিনুরের নাম বলেন। মহিউদ্দীন আরও জানান, হিযবুতের নারী শাখার প্রধান ফারিয়া আফসানা ওরফে মুনমুন হাসিনুরের শ্যালিকা। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তদন্তে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসার পর কর্নেল হাসিনুরকে সেনাবাহিনীতে ফেরত পাঠানো হলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। একপর্যায়ে গ্রেফতার হয়ে তিনি জেলে যান। পাঁচ বছর কারাভোগ করে ২০১৪ সালে জামিনে ছাড়া পান। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে তিনি প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিলেন। যে কারণে তিনি বর্তমান সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েন। হাসিনুর রহমানের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত বুধবার রাতে তাকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে। এ অভিযোগের সুরাহা এখনো হয়নি। কোনো সংস্থার তরফ থেকে তাকে গ্রেফতারের তথ্যও জানানো হয়নি।