এ যেন ‘আঙুল ফুলে বটগাছ’ হওয়ার কাহিনি। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৮ তলা ভবনের মালিক হয়েছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার ওসি সাইরুল ইসলাম। ভবনটির আনুমানিক মূল্য ১১ কোটি টাকা। কনস্টেবল থেকে পদোন্নতি পেয়ে ওসি হওয়া এই পুলিশ কর্মকর্তা নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। একুশে পত্রিকার অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে ওসি সাইরুলের সম্পদের ভান্ডার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত বসুন্ধরা আবাসিকের এম ব্লকে ৪২১৪ নম্বর প্লটে ৪ কাটা জমি কিনেছেন সাইরুল ইসলাম। উক্ত জমিতে তিনি নির্মাণ করেছেন ৮ তলা সুরম্য ভবন। ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে সম্প্রতি। নজরদারির সুবিধার্থে ভবনটির বাইরে স্থাপন করা হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা।
ভবনটির বর্তমান বাজার মূল্য সম্পর্কে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘৪ কাটা জমির উপর ৮ তলা ভবন করা হলে এটির মোট স্পেস দাঁড়াবে প্রায় ১৮ হাজার ৪৩২ বর্গফুট। এটি নির্মাণে ব্যয় হতে পারে প্রায় ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। বর্তমানে এটির বাজার মূল্য হতে পারে প্রায় ১১ কোটি ৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা।’
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, যশোরের প্রাণকেন্দ্র কোতোয়ালী থানার সিটি কলেজ পাড়ায় ওসি সাইরুল ইসলামের রয়েছে ৬ দশমিক ৬০ শতক জমি। যশোরের একজন সংবাদকর্মী জানিয়েছেন, সিটি কলেজের সামনেই মনিহার সিনেমা হল। সেখানে আগে বাসস্ট্যান্ড থাকলেও এখন নেই। তবে রাতের বেলা দূরপাল্লার বাসগুলো মনিহার থেকেই ছাড়ে। ওই এলাকায় জমির প্রচুর দাম। সিটি কলেজ পাড়ায় প্রতি শতক জমির দাম সর্বনিম্ন ৭ লাখ টাকা; রাস্তার পাশে বা একটু ভালো জায়গায় হলে জমির দাম প্রতি শতক ১০ লাখ টাকা। সে হিসেবে ওসি সাইরুলের উক্ত জমির মূল্য হতে পারে সর্বোচ্চ ৬৬ লাখ টাকা।
এদিকে ছেলে মো. সৌমিক হাসানকে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ হার্টফোরশায়ারে পড়ালেখা করাচ্ছেন ওসি সাইরুল ইসলাম। ২০১৫ সাল থেকে লন্ডন, তুরস্ক, ইটালি, মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমন করেছেন সৌমিক; যা তিনি নিজের ফেইসবুক পাতায় শেয়ার করেছেন। এমনকি প্রাইভেট হেলিকপ্টারেও সৌমিকের চলাফেরা করার মুহুর্ত ফেইসবুকে দেখা গেছে।
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ পুলিশে কনস্টেবল পদে যোগ দেন সাইরুল ইসলাম। মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর থানার ওমেদপুর গ্রামের শেখ আবদুল আলেক ও শেখ সবুরন নেছার সন্তান তিনি। আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছিলেন তারা। যার কারণে পুলিশের কনস্টেবল পদে যোগ দিয়ে পরিবারের হাল ধরেন সাইরুল। পরে পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও, বায়েজিদ বোস্তামী ও মিরসরাই থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাইরুল। চাকরিজীবনে তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাননি। শুধুমাত্র পুলিশে চাকরি করে ওসি সাইরুল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সম্প্রতি দুদকে জমা হওয়া আয়শা আকতার কাকলী নামের চান্দগাঁওয়ের এক বাসিন্দার অভিযোগ থেকে জানা যায়, সাইরুলের স্ত্রী সৈয়দ তাসলিমা ইসলাম ব্যক্তিগত চালকসহ ব্যবহার করেন দামি প্রাইভেট কার। ওসি সাইরুলসহ পরিবারের সদস্যরা বহুবার বিভিন্ন উন্নত দেশে সফর করেছেন। এত বিলাসী জীবনযাপনের পরও আয়কর বিবরণীতে বছরে মাত্র আড়াই লাখ টাকা পারিবারিক ব্যয় দেখিয়েছেন ওসি সাইরুল ইসলাম।
এদিকে দুদকের কাছে তথ্য আছে, আয়কর বিবরণীতে ৫০ ভরি স্বর্ণালংকার ও নগদ ১১ লাখ ২৩ হাজার ৯৫৮ টাকা আছে বলে তথ্য দিয়েছেন ওসি সাইরুল। তার সম্পদ স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়দের কাছেও রয়েছে। স্ত্রী সৈয়দা তাসলিমা ইসলামের নামে ঢাকায় কোটি টাকা দামের ফ্ল্যাট আছে। সেখানে স্ত্রী-সন্তানরা বসবাস করেন। বিলাসবহুল উক্ত ফ্ল্যাটে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ দামি আসবাবপত্র। বনানীতেও একটি বহুতল ভবন আছে। সাইরুলের সম্পদ ভাই সাইফুল ইসলামের নামেও রয়েছে। নামে-বেনামে অন্তত ৮০টি কাভার্ড ভ্যান রয়েছে ওসি সাইরুল ইসলামের; যা তার ভাই সাইফুল পরিচালনা করেন বলে অভিযোগ। তার পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য রয়েছে একাধিক গাড়িও। ওসি সাইরুল বেনামে কুমিল্লায় দুটি পেট্রোল পাম্পেরও মালিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে দুদকে যাওয়া ওই অভিযোগে।
দুদক কর্মকর্তাদের ধারণা, ওসি সাইরুলের যেসব সম্পদের তথ্য তাদের হাতে আছে, তার বাইরেও অনেক সম্পদ রয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন হিলভিউ হাউজিং সোসাইটির এক নম্বর সড়কে হিলভিউ টাওয়ারের তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন ওসি সাইরুল; ওই ফ্ল্যাটটি তিনি কিনেছেন বলে ধারণা করছেন দুদক কর্মকর্তারা। সত্যতা যাচাইয়ে এসব বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান করছে দুদক।
দুদকে জমা পড়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, সাইরুল ইসলামের একান্ত অনুগত কিছু পুলিশ সদস্য রয়েছেন; ওসি সাইরুলের যে থানায় যোগ দেন তাদেরও একই থানায় বদলি করে নিয়ে যান। তাদের মধ্যে রয়েছেন এসআই পীযুষ কান্তি সিংহ, এসআই গোলাম মোহাম্মদ নাসিম, এএআই মনিরুল ইসলাম, এএসআই আতাউর রহমান, কনস্টেবল মো. রহিম। এই পুলিশ সদস্যরা ওসি সাইরুলের ‘টাকা আয়ের মেশিন’ হিসেবে কাজ করেন বলে দুদকে অভিযোগ করেছেন আয়শা আকতার কাকলী।
তিনি দুদককে আরো তথ্য দিয়েছেন, বোয়ালখালী থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেয়ার দিনই নিজের কক্ষে ব্যক্তিগত খরচে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র স্থাপন করেন সাইরুল ইসলাম। বোয়ালখালীর সিও অফিসের মীর পাড়া সড়কে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন তিনি; সেখানেও লাগিয়েছেন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র।
অভিযোগ রয়েছে, বোয়ালখালীতে যোগ দিয়েই সরকারবিরোধী লোকজনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন ওসি সাইরুল ইসলাম। বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন খান মুকুলের পরামর্শ মতো ওসি সাইরুল কাজ করেন বলেও অভিযোগ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোয়ালখালীর একজন বাসিন্দা একুশে পত্রিকাকে জানান, কর্ণফুলী নদীর তীরের একটি জমি রেজিস্ট্রি করে কেনার পরও সেটা তারা ভোগ-দখল করতে পারছেন না। বিএনপি নেতা মুকুলের পক্ষ নিয়ে ওসি সাইরুল তাদেরকে ভোগ-দখলে বাধা দিচ্ছেন।
অভিযোগের বিষয়ে বোয়ালখালী থানার ওসি সাইরুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, এগুলো ভিত্তিহীন অভিযোগ। এগুলো করে কি লাভ? এ অভিযোগগুলোর কোন সত্যতা নেই। আমার ব্যক্তিগত, পারিবারিক সম্পদ থাকতে পারে না? এটা কী কথাবার্তা।
দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক মো. আবদুল করিম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ওসি সাইরুলের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সাইরুলের বিরুদ্ধে আরো কোন অভিযোগ থাকলে দুদককে সরবরাহ করার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত গত বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে বোয়ালখালী থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেন সাইরুল ইসলাম। এর আগে ২০১৫ সালে নগরের চান্দগাঁও থানায় ওসি সাইরুলের দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে ফাঁদে ফেলে নিরীহ মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায়, মাদক দিয়ে মামলায় জড়ানো, টাকার বিনিময়ে অব্যাহতি দেয়া, দুর্ব্যবহার, ধরে নিয়ে গুলি করাসহ বেশকিছু অভিযোগ উঠে।
এর আগে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর ‘সরকারি গাড়ি নয়, কর্মস্থলে ব্যক্তিগত গাড়িতে ঘোরেন ওসি!’ শিরোনামে একটি বিশেষ সংবাদ প্রকাশ করে একুশে পত্রিকা। এতে উল্লেখ করা হয়, বোয়ালখালী থানার নতুন ওসি সাইরুল ইসলাম সরকারি গাড়ির পরিবর্তে ব্যক্তিগত বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করছেন।
ওই প্রতিবেদনে ক্ষুব্ধ হয়ে গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদারের বিরুদ্ধে নিজের থানায় ‘সাধারণ ডায়েরি’ (জিডি) করেন বোয়ালখালী থানার ওসি সাইরুল ইসলাম।
নিজের অনৈতিক কর্মকাণ্ড আড়াল করতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওসি সাইরুলের জিডি করায় সে সময় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ।
জানতে চাইলে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক একুশে পত্রিকাকে বলেন, অভিযোগের সত্যতা থাকলে ওসি সাইরুলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার দুদকের রয়েছে। এর বাইরে আমরাও অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখবো। সত্যতা পেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবো।
সুত্র:ক্রাইম সিলেট