দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাম্প্রতিক সময়ের শুদ্ধি অভিযান এখন দেশের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ অভিযানকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন অনেকে। আবার বিরোধীপক্ষ সমালোচনাও করছেন।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর মতিঝিলের একাধিক ক্লাবে পশ্চিমা ধাঁচের উন্নত জুয়ার আসরে ‘ক্যাসিনোবিরোধী’ অভিযান শুরু করে পুলিশের এলিট ফোর্স- র্যাব। র্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো মেলার পাশাপাশি সেগুলো পরিচালনায় যুবলীগ নেতাদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায়। ওইদিনই গ্রেফতার হন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, পরদিন কলাবাগান ক্লাব থেকে গ্রেফতার হন কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ। দুদিন পর গ্রেফতার হন ঠিকাদার জি এম শামীম, যিনিও যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। এরপর একে একে থানা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন নেতার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। উদ্ধার করা হয় অবৈধ অস্ত্র, লাখ লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার।
অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনায় যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের নাম আলোচিত হওয়ায় তার দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয় ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও তার স্ত্রী ফারজানা চৌধুরী এবং ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার স্ত্রীর এছাড়া গ্রেফতার হওয়া যুবলীগ নেতা জি কে শামীম ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার নিজস্ব এবং পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও জব্দ করা হয়। কে, কখন ধরা খান এমন আতঙ্কে রয়েছেন দুর্নীতিগ্রস্ত, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, সন্ত্রাসী, টেন্ডারবাজি কাজে অভিযুক্ত মন্ত্রী-এমপিরা।
চলমান শুদ্ধি অভিযান নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছে বিরোধীপক্ষও। জাতিকে বিভ্রান্ত করতে সরকার তথাকথিত শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। চলমান ‘ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী’ অভিযান প্রসঙ্গে সরকারের উদ্দেশ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, শুধু নিচের দিকে নয়, উপরের দিকেও শুদ্ধি অভিযান শুরু করুন।
তবে ক্ষমতাসীনরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, আটটি বিশেষ লক্ষ্য অর্জনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। বিগত দিনে সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যে এমনটি উঠে এসেছে।
সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যে নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া অঙ্গীকার অনুযায়ী দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন, অবৈধ ক্যাসিনোর মাধ্যমে অর্থপাচার ঠেকানো, সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা, আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত ও ঠেকানো, দলকে বিশুদ্ধ করা, দলকে শক্তিশালী করা, দলের কিছু নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্যে লাগাম টানা এবং ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা- এ আট লক্ষ্য অর্জনের বিষয় উঠে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচ টি ইমাম বলেন, ইতোমধ্যে যাদের ধরা হয়েছে তারা সবাই অনুপ্রবেশকারী। আপনারা জানেন যে, দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দলের মধ্য থেকে একটি দাবি উঠছিল, এসব অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের ভয়ানক ক্ষতি করছে। তাদের এখন আমরা চিহ্নিত করেছি। চিহ্নিত করে দেখা যাচ্ছে সবাই একসময় হয় যুবদল করতো, না হয় বিএনপি করতো বা জামায়াত-শিবিরের সদস্য ছিল। কাজেই তাদের খুঁজে খুঁজে যেহেতু আমরা বের করে ফেলেছি, এজন্য তাদের পক্ষ হয়ে এতদিন যারা কাজ করছিল তারা চিহ্নিত হয়ে গেছে। তাদের গাত্রদাহটা ওইখানে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, গুটিকয়েক লোকের কারণে দলের অপকর্মের দায়ভার আওয়ামী লীগ নেবে না। আমি আপনাদের আহ্বান জানাব, আওয়ামী লীগকে বিশুদ্ধ করুন, আওয়ামী লীগ থেকে দূষিত রক্ত বের করে দিন। বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালন করুন। এটাই আজ সময়ের আহ্বান। সেটাই আমাদের নেত্রীর (শেখ হাসিনার) চাওয়া। তিনি নিউ ইয়র্কে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেই এবার আমরা শপথ নিয়েছি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুর্নীতিমুক্ত দেশ আমরা গড়বই। এখানে কোনো ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ সভাপতি।
আওয়ামী লীগের অপর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ বলেন, তৃণমূল থেকে পাবলিক এ অভিযানের পক্ষে। তারা দুর্নীতির বিপক্ষে, চাঁদাবাজির বিপক্ষে। তাহলে অটোমেটিক এটা আমাদের পক্ষে আসবে। মদ, জুয়া, ক্যাসিনো ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স দেখাব।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আওয়ামী লীগ করলে যা ইচ্ছা তা করা যায় না। আওয়ামী লীগ করতে লাগে নীতি, আদর্শ এবং জনগণের জন্য ত্যাগ স্বীকার। নির্বাচনী ইশতেহারে মোট ২১টি অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন নম্বর হচ্ছে দুর্নীতি নির্মূল করা। বঙ্গবন্ধু কন্যা নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপস করেন না। দেশের জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে তিনি এ অঙ্গীকার করেছেন, এখানে কোনো আপস নয়। ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তিনি (শেখ হাসিনা) চলমান অভিযান অব্যাহত রাখবেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, চলমান অভিযানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগও কিছুটা শুদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। দলে অনুপ্রবেশকারীরা চিহ্নিত হচ্ছে, যারা অতীতে অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে নিজেদের নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল তারা সতর্ক হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার ফলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করবে।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, নেত্রীর এমন অভিযানের সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের অনেক বড় উপকার করেছে। তৃণমূল পর্যায়ে যারা এতদিন দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছে তারা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। এতদিন দল বেচে যারা চলেছেন, তারা কোণঠাসা হওয়ায় ত্যাগীদের যথাযথ মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে।