গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যে আরও সংকুচিত হয়েছে, তা অনুধাবন করার জন্য বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার পর্যবেক্ষণের দিকে না তাকালেও চলে। এ দেশের গণমাধ্যমে কর্মরত পেশাদার সাংবাদিক থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী নাগরিক পর্যন্ত প্রত্যেকেই তা উপলব্ধি করছেন। তথাপি প্যারিসভিত্তিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) সর্বসাম্প্রতিক বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান আমলে নেওয়া প্রয়োজন।
আরএসএফের প্রতিবেদন বলছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশ গত এক বছরে দুই ধাপ নিচে নেমে গেছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে ভালো থেকে খারাপের দিকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪৬তম। আগের বছর আমাদের স্থান ছিল ১৪৪তম। একদিকে সরকারি তরফ থেকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের, কিছু ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া, অন্যদিকে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের তরফ থেকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হুমকি বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিবেশ সংকুচিত করেছে বলে আরএসএফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের প্রায় সব অঞ্চলে সংবাদকর্মীরা স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ভয়ভীতি, এমনকি শারীরিক আক্রমণেরও শিকার হন। জঙ্গিরা কয়েক বছর ধরে লেখক, প্রকাশক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও ব্লগারদের হত্যা করে আসছে। তাদের পক্ষ থেকে হত্যার হুমকি স্বাধীন মতপ্রকাশের প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এবং সার্বিকভাবে একটা ভীতির পরিবেশ কাজ করছে।
কিন্তু গণমাধ্যম তথা স্বাধীন মতপ্রকাশের চর্চাকারী ব্যক্তিদের ওপর উগ্রপন্থীদের আক্রমণ ও হুমকি প্রদানের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেনি, বরং একধরনের নমনীয়তা প্রদর্শন করে এসেছে। এর ফলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর আক্রমণকারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো ‘সিস্টেম্যাটিক ইমপিউনিটি’ বা ব্যবস্থাগত দায়মুক্তি ভোগ করে আসছে।
এই পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক মঙ্গলের প্রতিবন্ধক, কেননা এতে জাতির গণতান্ত্রিক বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়ের পরিবেশে যখন সুশাসন, জবাবদিহি, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে, তখন গণমাধ্যমই জনগণের পক্ষে এসবের প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে। জনগণের দেওয়া ম্যান্ডেট যখন ক্ষমতার অপব্যবহারে রূপান্তরিত হয় এবং এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কোনো প্রতিরোধ থাকে না, তখন গণমাধ্যম সঠিক তথ্য প্রদান ও গঠনমূলক সমালোচনার দ্বারা শাসনযন্ত্রকে সঠিক পথে চলতে সহযোগিতা করে। সর্বোপরি, গণমাধ্যম গণতন্ত্র ও আইনের শাসন অটুট রাখার পক্ষে কাজ করে।
সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমেই সংকুচিত হলে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সরকারের দায়িত্ব গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা। তার উল্টোটা নয়।