পর পর তিনটি হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে রাস্তায় সন্তান প্রসব এবং নবজাতক মারা যাওয়ার ঘটনায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (ডিএমসিএইচ) কর্তৃপক্ষের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ঢাকা মেডিক্যালের ওই প্রতিবেদন অস্পষ্ট ও স্ববিরোধী।
গোটা প্রতিবেদনই প্রশ্নবিদ্ধ। এই প্রতিবেদন দেখলে মনে হবে তাদের (ডিএমসিএইচের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও স্টাফ) কোনো দোষ নেই। সব দোষ ওই বেচারা গরিব মানুষটির। গরিবরা কি চিকিৎসা পাবে না?
বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল সোমবার এসব মন্তব্য করেন। আদালত আগামী ২৭ নভেম্বর পরবর্তী আদেশের দিন ধার্য করেন। ডিএমসিএইচের তিন সদস্যের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর তা দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আদালত। আদালতে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস।
এদিকে আদালত দৈনিক যুগান্তর ও এশিয়ান এজ পত্রিকাকে এ বিষয়ে প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
হাইকোর্ট গত ১৯ অক্টোবর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাস্তায় সন্তান প্রসবের ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে ডিএমসিএইচ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের পরিচালক এবং আজিমপুর মাতৃসদনের তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দেন।
অন্তর্বর্তীকালীন এই নির্দেশনার পাশাপাশি রুল জারি করা হয়। রুলে ওই ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এবং ওই প্রসূতিকে কেন পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে এ আদেশ দেন আদালত।
ওই নির্দেশের পর ডিএমসিএইচের সহকারী পরিচালক (অর্থ ও স্টোর) ডা. মো. খলিলুর রহমানকে চেয়ারম্যান এবং আবাসিক সার্জন (গাইনি ও অবস) ডা. রওশন আরাকে সদস্যসচিব করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্য হলেন আবাসিক সার্জন (ইমার্জেন্সি ও ক্যাজুয়ালটি) ডা. মো. আলাউদ্দিন। এই কমিটি গত ৭ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এ ছাড়া মিটফোর্ড হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আবদুস সালামকে সভাপতি এবং সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. সাফিয়া আখতারকে সদস্যসচিব করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন গাইনি বিভাগের ডা. আয়শা সিদ্দিকা ও রুমি নাহরীন।
এই কমিটি গতকাল প্রতিবেদন দেয়। দুটি প্রতিবেদনই গতকাল আদালতে উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।
ডিএমসিএইচের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো নার্স বা স্টাফ টাকা দাবি করেননি। আর রোগিনীর প্রসবের অবস্থা প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। তাই তাকে নরমাল প্রসবের জন্য অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। কিন্তু তারা কাউকে কিছু না জানিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে যায়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এই কমিটি আজিমপুর মেটারনিটিতে তদন্ত করেছে। সেখানে সকাল ১১টায় স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে।
এই প্রতিবেদন দেখে আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আদালত বলেন, আজিমপুর মেটারনিটিতে তদন্ত করার এখতিয়ার এই কমিটির নেই। আর আজিমপুর মেটারনিটিতে স্বাভাবিক প্রসব হয়নি। রাস্তার ওপর প্রসব হয়েছে। সুতরাং এই তদন্ত প্রতিবেদন বানোয়াট, স্ববিরোধী ও অস্পষ্ট। ডিএমসিএইচ ও মিটফোর্ডের প্রতিবেদনে ওই রোগী ভর্তির বিষয়ে যে সময়ের উল্লেখ কর হয় তা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন আদালত। বলেন, একটি সরকারি হাসপাতাল থেকে আরেকটি সরকারি হাসপাতালে রোগী কি উড়ে গেছে যে এত অল্প সময়ে পৌঁছে গেছে? আদালত বলেন, ডিএমসিএইচের প্রতিবেদন দেখলে মনে হবে তাদের কোনো দোষ নেই। স্টাফদের কত সাফাই গাওয়া হয়েছে। আদালত বলেন, স্বাভাবিক প্রসবই যদি হবে আর প্রাথমিক পর্যায়েই যদি থাকবে তাহলে রাস্তায় কেন প্রসব করা হলো? এ থেকে ধরে নিতে হবে যে এই প্রতিবেদন সত্য নয়? আদালত বলেন, ভর্তির যে ফরম আদালতে দেখানো হচ্ছে তাতে পারুল নামের কোনো রোগীর স্লিপে একটানে
পারুল কেটে পারভীন করা হয়েছে। আসলে পারভীনকে ভর্তিই করা হয়নি।
গত ১৭ অক্টোবর আজিমপুর মেটারনিটি হিসেবে পরিচিত আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সামনে খোলা জায়গায় পথচারীদের সহায়তায় সন্তান প্রসব করেন পারভীন আক্তার (২৬)। নবজাতক প্রথমে নড়াচড়া করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। ওই দিন সন্ধ্যার পর নবজাতককে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় ‘তিন হাসপাতাল ঘুরে খোলা স্থানে সন্তান প্রসব নিয়ে তোলপাড়’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়