নাফনদী সাঁতরিয়ে এবার বাংলাদেশে ঢুকেছে ২২ রোহিঙ্গা যুবক। শুক্রবার (৩ নভেম্বর) বিকালে নাফ নদী সাঁতরিয়ে পৃথকভাবে বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছান এই ২২ রোহিঙ্গা যুবক।
সাড়ে তিন ঘণ্টা জারিকেন বুকে নাফ নদী সাঁতরিয়ে বিকাল সাড়ে ৪ টায় শাহপরীর দ্বীপ জেটির কাছাকাছি পৌঁছলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)’র শাহপরীর দ্বীপ বিওপির কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে বিজিবি সদস্যরা তাদের উদ্ধার করে। এরপর আরো তিন রোহিঙ্গা যুবক সাতরিয়ে আসেন। শুক্রবার রাত পর্যন্ত তারা বিজিবি হেফাজতে রয়েছেন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে বিজিবি।
নাফ নদীর লোনা জল সাঁতরিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা হলেন, রাসিডং এলাকার আব্দুল মোনাফ (৩০), ছাবের আহমদ (১৪), বুসিডং এলাকার আনোয়ার খালেদ (১৯), জাহেদ উল্লাহ (২২), মোহাম্মদ ইয়াছিন (১৫), রহমত উল্লাহ (১৭), আজিজুর রহমান (১৮), মোঃ আয়াজ (১৬), আবু সৈয়দ (২৪), মোঃ নুর (১৮), কবির আহমদ (২১), সিরাজুল ইসলাম (৩২), নুর কবির (২৪), পুইম আলী এলাকার মোঃ আয়ুব (২৬), নজির আহমদ (২০), আব্দুল আজিজ (২২), জহির আহমদ (২২), মংডু কাইন্দা পাড়ার মোঃ নুর (১৯),মংডু শহরের ফরিদ আলম (১৭)। পরে আসা তিন রোহিঙ্গার নাম ঠিকানা রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
সাঁতরিয়ে আসা রোহিঙ্গা যুবক আবু সৈয়দ জানায়, ‘আমরা ধাওনখালী সীমান্তে চরে এসে অপেক্ষা করেছি এগারো দিন। সেখানে তাবু করে নৌকার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। খাবার যা ছিল তাও ফুরিয়ে গেছে, ছোট বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
আমাদের চোখের সামনে চরে অপেক্ষমানদের দুই তিন জন করে শিশু প্রতিদিন মারা গেছে। কিন্তু এ সাতদিনে আমরা কোন নৌকা পাচ্ছিলামনা বাংলাদেশে ঢুকতে। প্রতিরাতে দুই একটা নৌকা ধাওনখালী সীমান্তে গেলেও অতিরিক্ত ভাড়া দিতে না পারায় নৌকায় ওঠা হয়নি আমাদের। সেনারা এসে আমাদের কাছে মিয়ানমার মুদ্রা যা ছিলো তাও ছিনিয়ে নিয়েছে। আমরা প্রায় অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের মায়েরা অনুরোধ করেছে সাঁতরিয়ে বাংলাদেশ ঢুকতে, তাদের জন্য কোন উপায় খুঁজে বের করা যায় কিনা। ’
ওই রোহিঙ্গা যুবক আরো জানায়, মিয়ানমারের রাখাইনের বুসিডং এলাকার প্রায় তিন শতাধিক পরিবার সেদেশের সেনা ও মগদের নির্যাতনে প্রাণ রক্ষার্থে বাংলাদেশ পালিয়ে আসার লক্ষ্যে ওপারের ধাওনখালী সীমান্তে জড়ো হয়েছে। সেখানে তারা কেউ একমাস, কেউ দশ থেকে পনের দিন অপেক্ষার পরও এপারে ভিড়তে কোন নৌকা না পাওয়ায় আটকা পড়ে মানবিক বিপর্যয়ের মুখে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে।
সাঁতরিয়ে আসা রোহিঙ্গা যুবক আনোয়ার খালেদ জানায়,‘মিয়ানমার সেনারা আমাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রায় দেড় মাস আগে আমরা বুসিডং ছেড়ে ঢংখালী সীমান্তে এসে অবস্থান করি। সেখানে আমাদের মতো এখনো আরো প্রায় ২০ হাজারের মতো নারী-শিশু সহ রোহিঙ্গারা এপারে ঢুকতে অপেক্ষা করছে। এপারে ঢুকতে কোন নৌকা না পাওয়াতে তারা খুবই ভয়ের মধ্যে আছে। তাদের কান্নাকাটি সইতে না পেরে ওপারে ফেলে আসা মা-বোনদের বাঁচার আকুতিটুকু বাংলাদেশে গিয়ে জানাবো এমন আশায় আমরা ২২ যুবক মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে সাঁতরিয়ে বাংলাদেশ এসেছি। ’
আরেক রোহিঙ্গা যুবক আজিজুর রহমান জানায়, ‘সেনা ও মগরা আমাদের ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছেনা। ঘর থেকে বের হয়ে বাজার বা দোকানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের জন্য বেরোতেও দিচ্ছেনা। একদিকে আমাদের বাড়িঘরে খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে, পাশাপাশি সেনাদের হাতে যেকোন মুহূর্তে প্রাণ হারানোর ভয়তো থাকছেই। তাছাড়া এখনো রাখাইনে যেসব রোহিঙ্গা রয়ে গেছে তাদের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) নিতে বাধ্য করছে সেনারা। এমন পরিস্থিতি আমরা বাংলাদেশে একটু আশ্রয় চাইতে এসেছি। ’
উল্লেখ্য, এর আগেও গত চার দফায় নাফ নদী সাঁতরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিল ২৩ রোহিঙ্গা যুবক। প্রথমবার গত ১১ অক্টোবর ১১ জন এবং শেষ তিনবারে চার জন করে ১২ জন। সর্বশেষ আজ একযোগে আসে ২২ রোহিঙ্গা। এ নিয়ে পাঁচ দফায় নাফ সাঁতরিয়ে বাংলাদেশের টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে সীমান্তে ঢুকেছে ৪৫ জন রোহিঙ্গা।