দুর্নীতি ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দায়ে অভিযুক্ত এক সময়ের সর্বহারা জিয়া গ্রুপের আঞ্চলিক সহকারী পরিচালক ও জামায়াত শিবিরের ক্যাডার বাবুগঞ্জের এক তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীকে জেএসসি পরীক্ষার পরে এবার পিএসসি পরীক্ষাতেও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষকদের চেয়ে নিম্নশ্রেণীর এক বিতর্কিত কর্মচারীকে পরীক্ষা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা অর্পণ করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সবাই।
পিএসসি পরীক্ষায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত যুব উন্নয়ন অফিসের ক্রেডিট সুপারভাইজার এ.কে.এম শহিদুল ইসলামের খুঁটির জোর নিয়েও জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। এ ঘটনায় উপজেলার শিক্ষক সমাজের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। ইউএনও’র ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান নিজেও।
১৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য পিএসসি পরীক্ষার বিভিন্ন কেন্দ্রের সচিব, হল সুপার ও শিক্ষক সমিতির নেতারা অভিযোগ করেন, উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসের ক্রেডিট সুপারভাইজার এ.কে.এম শহিদুল ইসলাম একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। উপজেলায় ৪০ জনের ওপরে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা থাকতেও একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীকে বারেবারে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে তাকে পরীক্ষা কেন্দ্রের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। ইউএনও’র বদান্যতা ও সুনজরে থাকায় এর আগেও জেএসসি পরীক্ষায় একই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল তাকে। তখন তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি, শিক্ষকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ ও বেপরোয়া ঘুষবাণিজ্য অভিযোগ থাকলেও তাতে কর্নপাত করেননি ইউএনও। এসব অভিযোগ জানানো হলেও তা অগ্রাহ্য করে তাকে আবার আসন্ন পিএসসি পরীক্ষায়ও একই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. জাহিদুর রহমান সিকদার জানান, সর্বহারা অধ্যুষিত শরিকল গ্রামের বাসিন্দা এ.কে.এম শহিদুল ইসলাম ছাত্রজীবনে জামায়াত শিবিরের রগকাটা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাহসিকতার কারণে তিনি সর্বহারা জিয়া গ্রুপের আঞ্চলিক সহকারী পরিচালক নির্বাচিত হয়েছিলেন ছিলেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে তিনি তার মামা এমপি জহির উদ্দিন স্বপনের ক্যাডার হিসেবে তার সুপারিশে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ক্রেডিট সুপারভাইজার পদে চাকরি লাভ করেন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে তিনি খোলস পাল্টিয়ে বাবুগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সখ্যতা তৈরি করে আওয়ামী লীগ বনে যান। তিনি ইউএনও অফিসের দালাল হিসেবে একই উপজেলায় ২৩ বছর যাবৎ চাকরি করছেন। বর্তমান পিএসসি পরীক্ষার আগে জেএসসি পরীক্ষায়ও উপজেলা থেকে তাকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। ওই ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি বিভিন্ন কেন্দ্রের সচিবদের কাছ থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করেছেন। শিক্ষকদের হয়রানি করা ছাড়াও এমনকি ভূতেরদিয়া কেন্দ্রে তিনি ছাত্রীদের তল্লাশীর নামে অসংখ্য ছাত্রীর শরীরে এবং স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিয়ে তাদের শ্লীলতাহানি করেছেন। শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করতে গেলে তিনি শিক্ষকদেরও তার ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাবলে গ্রেফতার এবং বহিস্কার করার হুমকি দিয়েছিলেন। জেএসসি পরীক্ষায় এসব অপকর্ম করার পরেও প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা বাদ দিয়ে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী সেই বিতর্কিত একই ব্যক্তিকে পিএসসি পরীক্ষার দায়িত্ব দিলে শিক্ষকরা তা কিছুতেই মানবে না বলে জানান উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি জাহিদুর রহমান সিকদার ও সাধারণ সম্পাদক মাসুদ আহমেদ খান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা পরিষদের এক কর্তকর্তা বলেন, পরীক্ষা কেন্দ্রের শুধু ম্যাজিস্ট্রেট নয়, এর আগে তাকে ভিজিডি, ভিজিএফ, ওএমএস চাল বিতরণ কর্মসূচিসহ বিভিন্ন প্রকল্পের ট্যাগ অফিসার হিসেবেও উপজেলা থেকে নিয়োগ করা হয়েছে। ওই চাল বিতরণে বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক অনিয়ম করেন তিনি। এনমকি চাল উত্তোলন না করে অর্ধেক চাল গোডাউনে বসেই বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ঈদের বিশেষ ভিজিএফ চাল বিতরণে কেদারপুরের ট্যাগ অফিসার হিসেবে ইউএনওর নাম ভাঙিয়ে ২ মে.টন চাল খাদ্য গুদামে আটকে রাখেন তিনি। অথচ এতকিছুর পরেও শুধু প্রশাসনের দালালি করায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে সামান্য একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীকেই বারেবারে কর্মকর্তা বানিয়ে সরকারি বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
গ্রামীণ সমাজ উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান মুক্তার হোসেন জানান, ছাত্রজীবনে জামায়াত শিবিরের রগকাটা বাহিনী থেকে সর্বহারা জিয়া গ্রুপের বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক মাইনউদ্দিন সিকদারের প্রধান সহযোগী ছিলেন এ.কে.এম শহিদুল ইসলাম। ১৯৯১ সালে তিনি সর্বহারা জিয়া গ্রুপের আঞ্চলিক সহকারী পরিচালক নির্বাচিত হন। বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) আসনের বিএনপির সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপনের ভাগ্নে হওয়ায় তার বিশ্বস্ত ক্যাডার হিসেবে বিভিন্ন অপারেশনে নেতৃত্ব দিতেন তিনি। শহিদুলের নেতৃত্বেই সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর গ্রামের বাড়ি ও আওয়ামী লীগ পার্টি অফিসে হামলা হয়েছিল। সেই কাজের পুরস্কার হিসেবে মামা জহির উদ্দিন স্বপন এমপির সুপারিশে তৎকালীন বিএনপি সরকার ১৯৯৫ সালে তাকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ক্রেডিট সুপারভাইজার পদে চাকরি দেয়। আওয়ামী লীগের ওপরে সশস্ত্র হামলার পুরস্কার হিসেবে ওই চাকরি পেলেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি শরিকল থেকে পালিয়ে খানপুরায় আত্মগোপন করেন। সেখানে নতুন বসতি গড়ে স্থানীয় এক হোমিও পল্লী চিকিৎসকের সুন্দরী মেয়েকে হুমকির মুখে প্রেমের সম্পর্ক গড়তে বাধ্য করেন এবং পরবর্তীতে অস্ত্রের মুখে তাকে বিয়ে করেন। তিনি বিগত ২০১০ সালে গ্রামীণ সমাজ উন্নয়ন সংস্থায় এসে নিজেকে সর্বহারা জিয়া গ্রুপের আঞ্চলিক পরিচালক দাবি করে ২ লাখ চাঁদা চেয়েছিলেন। সেই চাঁদার দাবিতে মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে এসে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে আমাকে হত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন মুক্তার হোসেন। তখন এ বিষয়ে যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আসমা বেগমের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল বলে জানান মুক্তার হোসেন।
এসব অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আসমা আক্তার লুনা বলেন, ক্রেডিট সুপারভাইজার শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে এনজিও চেয়ারম্যান মুক্তার হোসেনের লিখিত অভিযোগ ছাড়াও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। বিগত ২০১৪ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বরিশাল অঞ্চলের উপ-পরিচালক শামসুজ্জামানকে অস্ত্র ঠেকিয়ে মারপিট করেছিলেন তিনি। এ কারণে তখন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত খুঁটি জোরে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আবার স্বপদে বহাল হন। তাকে চট্টগ্রামের বাঁশখালি উপজেলায় বদলী করা হলেও তদবিরের জোরে ওই আদেশ বাতিল করিয়ে বাবুগঞ্জেই থেকে যান। বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতাদের দালালি করার পাশাপাশি গৌরনদীর বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপনের ভাগ্নে হওয়ায় তিনি বিএনপি সরকারের আমলেও মামার পরিচয়ে একছত্র দাপট ও অধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। ফলে তৃতীয় শ্রেণীর সামান্য কর্মচারী হয়ে নিজ দপ্তরের উপ-পরিচালককে মারপিট করার পরেও ২৩ বছর একই উপজেলায় বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুজিত কুমার স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, শহিদুল ইসলাম পূর্বে কী করেছেন সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। সরকারি বিধিমতে ইউএনও’র প্রতিনিধি হিসেবে একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান থাকলেও প্রথম অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা পাওয়া না গেলে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীকেও ক্ষমতা প্রদান করা যায়। সেটা ইউএনও’র ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। সে যদি সঠিকভাবে তার তার দায়িত্বে পালন করতে পারে তবে তৃতীয় শ্রেণী হলেও সমস্যা কোথায়? শহিদুলের বিরুদ্ধে বাইরে হাজার অভিযোগ থাকলেও আমি কোনো অভিযোগ পাইনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে দায়িত্ব থেকে তখন বাদ দেওয়া হবে বলে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)