এখন আর আগের মত বড় মাছ দেখা যায় না। কালেভদ্রে মেলা পার্বন ছাড়া বড় মাছ দেখতে পাওয়াটা এখন বিস্ময়।
কালে কালে নানা পণ্যের হাট বাজার হলেও এখন বাজার বা মেলা বসছে শুধু মাছ নিয়ে। আর সে মাছ হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ের সাথে কে কত বড় মাছ নিয়ে এসেছেন তা নিয়ে শুরু হয়েছে রীতিমত প্রতিযোগিতা।
প্রতিযোগিতা জয়ী হয় বড় মাছের মহাজন আর ওই মাছের ক্রেতা। যত বড় মাছ তত নাম তার। যত দিন যাচ্ছে নবান্ন উপলক্ষ্যে আয়োজিত মাছের মেলাও তত বড় হচ্ছে। প্রায় দেড়শত বছর ধরে এই মাছের মেলা হয়ে আসছে।
জানা যায়, বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার উথলীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নবান্ন উৎসব উপলক্ষে মেলা বসে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রায় ১৫০ বছর আগে থেকে এই মেলা বসছে উপজেলার উথলী নামকে স্থানে। এই মেলায় শুধু সনাতন ধর্মের মানুষই না স্থানীয় অন্যান্য ধর্মের মানুষও কেনাকাটা করে।
শুরুতে গ্রামীণ জনপদের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা আর খাবার ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যেত না। কিন্তু কালক্রমে এই মেলায় জমে উঠেছে মাছের জন্য করে। মেলায় বিভিন্ন সাইজের মাছ উঠে থাকে। নদী ও পুকুরে চাষ করা বড় মাছ বিক্রি কেনার প্রতিযোগিতা লেগে থাকে এই মেলায়।
শনিবার মেলায় এক কেজি থেকে শুরু করে ২০ কেজি ওজনের রুই, কাতলা, চিতল, সিলভার কাপ, ব্রিগেডসহ হরেক রকমের মাছ বিক্রি হয়। বিশালাকৃতির রুই-কাতলা ও চিতল মাছগুলো ছয়শ থেকে আটশ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও মাঝারি আকারের মাছ ৩০০ টাকা থেকে সাড়ে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ২০০-৩৫০ টাকা দরে ব্রিগেড ও সিলভার কাপ মাছ বেচাকেনা হয়। প্রায় ১৫০ বছরের প্রাচীন উথলী মাছের মেলাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের ২০ গ্রাম স্বজনদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পুঞ্জিকানুসারে শুনিবার সনাতন ধর্মাম্ববলীরা নবান্ন উৎসব পালন করেন। এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর মাছের মেলা বসে উথলীতে। সনাতন ধর্মাম্বলীদের নবান্ন উৎসব হলেও উথলী, রথবাড়ি, ছোট ও বড় নারায়ণপুর, ধোন্দাকোলা, সাদুল্লাপুর, বেড়াবালা, আকনপাড়া, গরীবপুর, দেবিপুর, গুজিয়া, মেদনীপাড়া, বাকশন, গনেশপুর, রহবলসহ প্রায় ২০ গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে ছিল উৎসবের আয়োজন। প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের আগে থেকেই নিমন্ত্রণ করা হয়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারা নতুন ধানে নবান্ন করেন।
নবান্ন উপলক্ষে সেখানে মাছের মেলা বসলেও জমি থেকে নতুন তোলা অন্যান্য শাক-সবজির পসরাও সাজানো হয় মেলা চত্বরে। শনিবার এই মেলায় নতুন আলু বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা কেজি দরে। এছাড়াও মিষ্টি আলু ও কেশর (ফল) প্রতি কেজি দেড়শ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।
বগুড়ার সোনাতলা থেকে লোহাগাড়া নদীর এলাকার মাছ ব্যবসায়ী অখিল চন্দ্র সরকার জানান, প্রতি বছরই তারা মেলায় মাছ বিক্রি করতে আসেন। গত বছরের তুলনায় এবার দাম কিছুটা বেশি বেচাকেনাও আশানুরূপ হয়নি।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট গ্রাম থেকে আসা মোসলেম উদ্দিন মিয়া জানান, মেলায় ছোট-বড় মিলে ২০০ মাছের দোকান বসেছে। প্রত্যেক বিক্রেতা অন্তত ৬ থেকে ১০ মণ করে মাছ বিক্রি করেছেন। মেলায় মাছ সরবরাহের জন্য ২০টি আড়ৎ খোলা হয়। সেসব আড়ৎ থেকে স্থানীয় বিক্রেতারা পাইকারি দরে মাছ কিনে মেলায় খুচরা বিক্রি করেন।
মেলায় ২০ কেজি ওজনের একটি বিগ্রেড মাছের দাম চাওয়া হয় সাড়ে ৬০০ টাকা হিসেবে ১৩ হাজার টাকা। পরে মোকামতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোকলেছার রহমান সেই মাছটি কিনে নেন ১২ হাজার টাকায়।
স্থানীয় উথলী গ্রামের বাসিন্দারা জানান, প্রায় দেড়শত বছর আগে থেকে এই মেলা বসছে। আগে মেলায় মাছের এত কদর না থাকলেও এখন মাছের কদর বেড়েছে। বড় মাছ মেলায় তোলার ও কেনার একটা প্রতিযোগিতাও দেখা যায়। মাছের পাশাপাশি মেলার দিন নতুন শাক-সবজিতেও ভরপুর থাকে। শুধু যে মাছ আর সবজিই নয়, মেলার আবহের জন্য সেখানে নাগরদোলা, শিশু-কিশোরদের খেলনার দোকান বসেছে। সেই সঙ্গে মিষ্টান্ন ও দইয়ের একটি বড় বাজারও বসেছে মেলা চত্বরে।
শিবগঞ্জের বাসিন্দা ও মেলার ইজারদার ওমর ফারুক জানান, আগে মেলাটি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা ব্যাপকতা লাভ করেছে। শুধু আশেপাশেরই নয় পুরো শিবগঞ্জ উপজেলার মানুষ এখানে নবান্নের বাজার করতে আসেন।
মাছের মেলার খবর পেয়ে জেলা শহর থেকেও অনেকে সেখানে ছুটে যান মাছ কিনতে। মূলত সনাতন ধর্মের নবান্নকে কেন্দ্র করে এই মেলা শুরু হয়। কবে কখন থেকে এই মেলা শুরু হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস না থাকলেও শত বছরের বেশি সময় ধরেই মেলা বসছে বলে জানান তিনি।