ডায়াবেটিস পৃথিবীতে মহামারী আকার ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসাবে ২০১৯ সালে প্রতি ১১ জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সংখ্যার হিসাবে যা ৪২৫ মিলিয়ন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪৫ সালে ৪৮ শতাংশ বেড়ে তা ৬২৯ মিলিয়ন হবে। পৃথিবীর মোট ডায়াবেটিস রোগীর ৮৭ শতাংশই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে বসবাস করছেন।
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘ডায়াবেটিস সেবায় পার্থক্য আনতে পারেন নার্সরাই’। পৃথিবীর প্রায় ১৭০টি দেশে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিশেষ বাণী দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারের সহায়তা অব্যাহত থাকবে। এ ব্যাপারে নানা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে ডায়াবেটিস। এটি কেবল ধনী দেশের রোগ নয়, উন্নয়শীল দেশে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও টাইপ-২ ডায়াবেটিস ৭০ শতাংশ সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা যায়। তবে তা অবশ্যই ডায়াবেটিস রোগ হওয়ার আগে। আর এই রোগ একবার হলে সেটা পুরোপুরি ভালো হয় না, তখন নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তাছাড়া ডায়াবেটিস আছে এমন রোগীদের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ জানেন না যে, তার ডায়াবেটিস আছে। এজন্য জনসচেতনতা বাড়ানো খুবই জরুরি।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং আক্রান্তের হার দুই বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম। ২০৩০ সেটি নবম অবস্থানে উন্নীত হবে। পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে উচ্চহারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে। দ্রুত নগরায়ন, মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি, মানুষের কায়িক শ্রম কমে যাওয়া, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে মানসিক চাপ বাড়া ইত্যাদি কারণে এসব দেশে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ডায়াবেটিস রোগ ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে কত মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে পরিসংখ্যান না থাকলেও আক্রান্তের সংখ্যা যে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে টাইপ-১ বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ডায়াবেটিসসহ অসংক্রামক রোগগুলো নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। একই সঙ্গে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জীবনযাত্রার মান ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের পাশাপাশি কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। নিয়মিত হাঁটাচলা ও ব্যায়াম করতে হবে। মাত্রাতিরিক্ত ফাস্টফুড খাওয়া ও কোমল পানীয় বর্জন করতে হবে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ধূমপান ও তামাক সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে। যাদের পরিবারে বাবা-মা বা নিকট আত্মীয়ের ডায়াবেটিস আছে তাদের ৪৫ বছরের পরে রক্তের গ্লুকোস পরীক্ষা করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যেটিকে প্রতিরোধ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। একবার কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে বাকি জীবন এই রোগ নিয়েই থাকতে হয়। তাই দেশের সর্বস্তরের মানুষকে সচেতনভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, এদেশে ডায়াবেটিস চিকিৎসা জরুরি। তার চেয়েও বেশি জরুরি ডায়াবেটিস প্রতিরোধের সর্বাত্মক সুগভীর কর্মকাণ্ড। দেশের সকল স্তরের মানুষকে যুক্ত কর এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
ডায়াবেটিসের ভয়াবহ এ পরিস্থিতির মধ্যে আজ সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস-২০২০’। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে—‘ডায়বেটিস-সেবায় পার্থক্য আনতে পারেন নার্সরাই’। দিবসটি উপলক্ষ্যে সারা দেশে ব্যাপক প্রস্ততি নেওয়া হয়েছে। প্রতি বছরের মতো বাংলাদেশসহ প্রায় ১৭০টি দেশে এ দিবস পালিত হবে। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ডায়াবেটিস সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টিই ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’-এর প্রধান লক্ষ্য। দিবসটি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সমিতির অন্যান্য অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত অধিভুক্ত সমিতিগুলোও এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। গতকাল শুক্রবার এ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি রাজধানীর শাহবাগ বারডেম হাসপাতালের কনফারেন্স হলে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকাল সাড়ে ৮টায় বারডেম হাসপাতালের সামনে রোড শো (প্ল্যাকার্ড হাতে সড়কে অবস্থান কর্মসূচি), সকালে ১১টায় রমনা পার্কের গেটের পাশে এবং এনএইচএন ও বিআইএইচএসের বিভিন্ন কেন্দ্র সংলগ্ন স্থানে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয়, সকালে সাড়ে ১০টায় বারডেম মিলনায়তনে আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর। এছাড়া বেলা ১১টায় বাডাস কনফারেন্স রুমে ভার্চুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রধান অতিথি হিসেবে সংযুক্ত হবেন। এসব কর্মসূচির পাশাপাশি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে হ্রাসকৃত মূল্যে হার্ট ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে। এসব অনুষ্ঠান ছাড়াও ডায়াবেটিস সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দৈনিক পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ, কান্তি’র বিশেষ সংখ্যা ও সচেতনতামূলক পোস্টার ও লিফলেট প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির পাশাপাশি সমিতির অন্যান্য অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত অধিভুক্ত সমিতিগুলোও এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে।