শেখ সুমন:
‘হাসিনা : এ ডটার’স টেল’। এই হাসিনা শুধুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নন। তিনি কখনো বঙ্গবন্ধুর কন্যা, কখনো বা কারো বোন, কখনো একজন নেতা, কখনো বা পুরো দেশ তথা ১৬ কোটি মানুষের ‘আপা’। আর এসব পরিচয় ছাড়িয়ে প্রতিফলিত হয় একজন সফল ও সংগ্রামী মানুষের ব্যক্তিসত্তা। ৭০ মিনিটের অসামান্য এই ডকুড্রামা তথা তথ্যচিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পরপরই সাড়া ফেলে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে ফিল্মটির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল শুক্রবার রাজধানী ঢাকার তিনটি ও চট্টগ্রামের একটি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে। ৭০ মিনিটের তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে শেখ হাসিনার সাধারণ জীবনের অসাধারণ কিছু মুহূর্ত। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও তাঁর পরিবারের সদস্যরা এসেছেন তথ্যচিত্রে।
সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) পাঁচ বছরে নির্মাণ করেছে ‘হাসিনা : এ ডটারস টেল’ ডকুফিল্ম। সিআরআইয়ের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শুক্রবার স্টার সিনেপ্লেক্সে সকাল ১১.৩০টা, দুপুর ১টা, বিকেল ৪.৫০টা, সন্ধ্যা ৬.৩০টা আর রাত ৮.১০টায় ফিল্মটি দেখানো হয়। আজ শনিবারও একই সময় সিনেমাটি দেখানো হবে। যমুনা ব্লকবাস্টারে রবিবার ক্লাব রয়ালে বিকেল ৩টায় কূটনীতিকদের জন্য একটি শো হবে। এখানে রাত ৮.০৫টায় দ্বিতীয় শো হবে সাধারণ দর্শকদের জন্য। এ ছাড়া অন্যান্য দিন বিকেল ৫টা ও সন্ধ্যা ৭.১৫টায় ক্লাব রয়ালে দেখানো হবে এই শো। ঢাকার মধুমিতা সিনেমা হলে শুক্রবার মোট চারটি শো দেখানো হয়। অন্যান্য দিন এখানে সকাল ১১টা, বিকেল ৩টা ও সন্ধ্যা ৬.৪৫টায় তিনটি শো দেখানো হবে। চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিনে থিয়েটার প্লাটিনামে প্রতিদিন সকাল ১১টা আর থিয়েটার টাইটানিয়ামে মুভিটি প্রতিদিন রাত ৯টায় দেখা যাবে।
অসামান্য এই তথ্যচিত্রে শেখ হাসিনা কখনো মেয়ে, কখনো মা, কখনো বোন, আবার কখনো আমজনতার নেত্রী। ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী দিনগুলোতে ঢাকায় এসে পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি দেখেছেন সংগ্রামে আর জেলে। নতুন দেশ গঠনের পর আশপাশের মানুষদের ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে শহীদ হন বঙ্গবন্ধু। দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়া তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা মুখোমুখি হন এক কঠিন বাস্তবতার। পিতা-মাতা কেউ বেঁচে নেই, তবু দুই কন্যা এগিয়ে যাচ্ছেন; ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পিতার দেখানো পথে অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করছেন।
সব কিছু হারিয়ে এক সফল সংগ্রামের নায়ক, মানবিক ও স্বরূপে উঠে আসা শেখ হাসিনা তরুণ প্রজন্মকে প্রেরণা জোগাবেন এমন মন্তব্য দর্শকদের। দর্শকরা বলছে, একজন রাষ্ট্র পরিচালক পরিচয়ের পাশাপাশি ব্যক্তি জীবনের নানা অজানা তথ্যে পরিপূর্ণতা পেয়েছে ফিল্মের শেখ হাসিনা চরিত্রটি।
পরিচালক পিপলু খান ৭০ মিনিট দীর্ঘ এই ফিল্মটি নির্মাণ করতে সময় নিয়েছেন পাঁচ বছর। সংগীতায়োজন করেন দেবজ্যোতি মিস্ত্র, সিমোটোগ্রাফিতে ছিলেন সাদিক আহমেদ ও সম্পাদনা করেন নবনিতা সেন। সিনেমাটির প্রযোজক সিআরআই ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও নসরুল হামিদ বিপু।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফিল্মটির প্রিমিয়ারে স্টার সিনেপ্লেক্সে সমবেত হয়েছিলেন রাজনীতি, অর্থনীতি, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা। পৌনে ৭টায় শীর্ষ দেশের গণ্যমান্য ও বিশিষ্টজনদের প্রথমে দেখানো হয় ফিল্মটি। এরপর রাত ৯টায় চলচ্চিত্র অঙ্গনের শিল্পী, গণমাধ্যমকর্মী ও সাধারণ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। গতকাল শুক্রবার বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্স, যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার ও মতিঝিলের মধুমিতা ও চট্টগ্রামের সিলবার স্ক্রিনেও প্রদর্শিত হয়। প্রতিটি হলেই ছিল দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়।
ফিল্মটির শুরুতে আন্দোলন সংগ্রামের বাইরে পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সময় কাটানো ও জেলে থাকা পরিস্থিতির চিত্রায়ণ করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলন চলার সময় তিন মাল্লার নৌকায় করে ঢাকায় আসে বঙ্গবন্ধুর পরিবার। স্বাধীনতা আনতে গিয়ে নানা সংগ্রামের মধ্যে পড়েন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়। স্বামীর সঙ্গে বেলজিয়ামে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাও। বিদেশে থাকার সুবাদেই বেঁচে যান দুই বোন। পিতাকে হত্যার পরই তাঁদের জীবনে নেমে আসে কঠিন বাস্তবতা। বেলজিয়ামেও থাকার সুযোগ হয়নি। জার্মানিতে আশ্রয় হওয়ার কথা চললেও ভারতে আশ্রয় নেন দুই বোন। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। ঘাত-প্রতিঘাতে এগিয়ে চলা সেই শেখ হাসিনা এখন একজন সফল রাষ্ট্রপ্রধান।
ফিল্মটিতে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর বিরোধীদের ষড়যন্ত্র, বঙ্গবন্ধুর দেশে ফিরে আসা ও পরিবারের সদস্যদের অপেক্ষা, ’৭৫ সালে পরিবারের সবাইকে হত্যা, বেলজিয়ামে দুই বোনের নিঃস্বতা, ভারতে আশ্রয় ও নাম পরিবর্তন করে ঘরে অবস্থান, ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার দেশে ফেরা, পিতা হত্যার বিচার চাওয়া, ’৯৬ সালের নির্বাচনে সরকার গঠন করে পিতৃ হত্যার বিচারে অডিন্যান্স বাতিল ও মামলা এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনার বেঁচে যাওয়ার অসাধারণ সব ঘটনা স্থান পেয়েছে ডকুড্রামায়। চলচ্চিত্রে দেখা যায়, পিতা-মাতা ও পরিবারের সদস্যদের হারালেও দুই বোনের একজন শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করে দেশ ও জনগণের সেবা করছেন, আর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে থাকছেন ছোট বোন শেখ রেহানা। দুই বোনের বর্ণনায় উঠে এসেছে তাঁদের জীবনের বেদনাবিধুর কাহিনি। ধরা পড়েছে জন্মস্থানের প্রতি শেখ হাসিনার অসামান্য টানও। ফিল্মের এক স্থানে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘টুঙ্গিপাড়া আসলে আমার খুবই ভালো লাগে। মনে হয় আমি আমার মায়ের কাছে, মাটির কাছে ফিরে এসেছি। আমার তো মনে হয়, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা টুঙ্গিপাড়া।’
গতকাল সকাল ১১টায় বসুন্ধরা সিটিতে দিনের প্রথম শো অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে দর্শকরা হলে ঢোকে। এক ঘণ্টা ১০ মিনিট দীর্ঘ ফিল্ম। এর পরও দেখতে কোনো ক্লান্তি বা বিরক্তি ছিল না। পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে দর্শকরা উপভোগ করেছে। বাঙালির ইতিহাসের অনেক বড় বড় ঘটনার দৃশ্যায়ন থাকায় অধীর আগ্রহে দেখেছে দর্শকরা।
বৃহস্পতিবার ফিল্মটির প্রথম দর্শনের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবুল মুহিত বলেন, ‘অসাধারণ একটি মুভি। কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নয়, একজন মানুষের জীবনের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৮৪ সাল থেকেই দেখছি। জানার তো শেষ নেই। নতুন অনেক কিছুই জানলাম।’ তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, ‘প্রত্যেকের উচিত এটা দেখা, একজন মা কিভাবে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছেন।
প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘এটি তরুণ প্রজন্মের কাছে সংগ্রামী জীবনের অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকবে। এটার মাধ্যমে তাঁর সংগ্রামীজীবন, ব্যক্তিজীবনের নানা লড়াই উঠে এসেছে, যা আগামী প্রজন্মকে সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগাবে।’ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, বাংলা চলচ্চিত্রের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের অন্যতম উদাহরণ এ চলচ্চিত্রটি। এতে শেখ হাসিনার ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে যেমন পরিচিত হয়েছি, তেমনি দেখেছি তাঁর অনুপ্রেরণা হিসেবে শেখ রেহানাকে। এর গল্প অত্যন্ত প্রাঞ্জল, অত্যন্ত সাবলীল।
ত্বোয়াহা ফারুকী নামে এক দর্শক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডকো-ফিকশনধর্মী এই ফিল্মটিতে অনেকগুলো ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। যেগুলো নিয়ে একেকটা মুভি হওয়ার উপাদান রয়েছে। পাশাপাশি ইতিহাসের অনেক বড় ঘটনার বর্ণনা রয়েছে, যেগুলো অনেকেরই অজানা। কাজেই দীর্ঘসময় হলেও কোনো বিরক্তি ছিল না। পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে সবাই উপভোগ করেছেন। শেখ হাসিনার জীবনে নানা প্রতিকূলতা ও ভাঙা-গড়ার উদাহরণ রয়েছে। শেখ হাসিনার জীবনী নিয়ে একটা বড় সিনেমাও হতে পারে।’