অর্থনৈতিক অসাম্য, সার্বিক অধিকারহীনতা, নির্বিচার গণহত্যা, পরিকল্পিত ধর্ষণ, লোলুপ লুণ্ঠন, নির্দয় ধ্বংসযজ্ঞের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। সংগ্রামের সেই পথ পুরোটাই ছিল রক্তে ভেজা। এর মধ্যে একাত্তরের নয় মাসজুড়ে চলা গণহত্যা ছিল বিশ শতকের অন্যতম পরিকল্পিত ও পদ্ধতিগত গণহত্যা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষকে তাড়িত করেছে। সাংবাদিক, লেখকদের করেছে গভীরভাবে আলোড়িত। তাঁদেরই একজন ছিলেন মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন। প্রথিতযশা এই লেখক স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। গণহত্যার তরতাজা তথ্য সংগ্রহ
করেছেন সমাজের নানা স্তরের মানুষ, পেশাজীবী, কূটনীতিক, সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিদের কাছ থেকে। আর সেই সব তথ্য জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর লেখা ম্যাসাকার গ্রন্থে।
লেনিন, স্তালিন, মাও সে-তুং, মহাত্মা গান্ধীসহ বিশ্বের নামজাদা অনেক ব্যক্তিত্বের জীবনী গ্রন্থাকার হিসেবে পরিচিত রবার্ট পেইন। মূলত ইতিহাস ও জীবনী লেখক হলেও বাংলাদেশের জন্মের অবর্ণনীয় বেদনা তাঁকে আবেগতাড়িত করেছে। শত গ্রন্থের এই লেখক দৃশ্যত সবার আগে বিদেশি পাঠকদের সামনে একাত্তরের বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন ম্যাসাকার বইয়ের মাধ্যমে। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশ পায় বইটি।
ওই বইয়ে একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বর্ণনার একপর্যায়ে তিনি লিখেছেন, ‘মাত্র ১৫ মিনিটে হত্যা করা হলো প্রাণোচ্ছল ১০৯ ছাত্রকে। ইকবাল হলের ছাদে মরদেহগুলো যেন শকুনের অপেক্ষায় ফেলে রাখা হলো। হিন্দু ছাত্রদের দেহগুলো রাখা হয়েছিল জ্বালানি কাঠের মতো স্তূপ করে। রাতে মরদেহগুলো কবর দেওয়ার জন্য কয়েকজন ছাত্রকে দিয়ে গর্ত খোঁড়ানো হলো। গর্ত খোঁড়া শেষ হলে তাদের গুলি করে সেই গর্তে ফেলে দিল পাকিস্তানি সৈন্যরা।’
আর টর্চার্ড অ্যান্ড দ্য ড্যামড (নির্যাতিত ও অভিশপ্ত) গ্রন্থে রবার্ট পেইন পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বন্দিজীবনের অনবদ্য চিত্র এঁকেছেন। তাঁর লেখা এ দুটি বই বাংলাদেশের গণহত্যার গবেষণায় অন্যতম সহায়ক গ্রন্থ।
পিয়েরে স্টিফেন রবার্ট পেইন ১৯১১ সালে যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। স্পেনে তিনি যুদ্ধ প্রতিবেদক ছিলেন। জাপানের সিঙ্গাপুর আক্রমণের সময় তিনি ছিলেন সিঙ্গাপুর নৌবাহিনীর আর্মামেন্ট অফিসার। তিনি একাধারে নৌ-স্থাপত্যবিদ্যা ও ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। পড়ালেখা করেছেন ক্যাপটাউন, লাভারপুল, নিউনিখ ও সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৩ সালে তিনি বারমুডায় মারা যান।