আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘সাজাপ্রাপ্ত এক আসামি লন্ডনে বসে নাটাই ঘুরায়। আল্লাহ যদি দিন দেয় তবে ওই সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ধরে নিয়ে এসে বাংলাদেশে তার বিচারের রায় কার্যকর করব।
গতকাল শনিবার সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে আয়োজিত বিশাল নির্বাচনী জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলাদেশের মান ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত করেছিল।
হত্যা, খুন, অগ্নিসন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি— এটাই ছিল তাদের নীতি। আঙ্গুল ফুলে তারা নিজেরা কলাগাছ হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দেশের সেই দুর্নাম কাটিয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশের মানুষের সম্মান নষ্ট করতে দেওয়া হবে না।’ আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জনসভার মঞ্চ তৈরি করা হয় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার আদলে।
ব্যাপক জনসমাগমে জনসভাটি রীতিমতো জনসমুদ্রে পরিণত হয়। প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে সিলেটজুড়ে বাড়ানো হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিকাল ৩টা ১২ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী জনসভাস্থলে আসলে উৎফুল্ল লাখো জনতা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে এলাকা প্রকম্পিত করে তোলেন। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে উঠে হাত নেড়ে সমবেত জনতাকে শুভেচ্ছা জানান। তখন জনতা তুমুল করতালি দিয়ে তাকে অভিবাদন জানায়। এর আগে সকালে সিলেট পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী হযরত শাহজালাল (র.), হযরত শাহ পরান (র.) এবং হযরত গাজী বোরহানউদ্দিন (রহ.) এর মাজার জিয়ারত করেন।
তিনি প্রতিটি মাজারে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, ফাতেহা পাঠ এবং বিশেষ মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন।একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নিলামের মাধ্যমে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে নির্বাচনে তারা কী করেছে? এক এক সিটে চার-পাঁচজন করে নমিনেশন দিয়েছে। দেবার পরে কী করেছে? একেকটা সিট অকশনে (নিলামে) দিয়েছে। যে যত টাকা দেবে সে নমিনেশন পাবে। এই অকশন দিতে গিয়ে তাদের এখন ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা। কেউ তাদের বিশ্বাস করে না। আপনারা জানেন- এই সিলেটের ইনাম আহমেদ চৌধুরী সাহেব, তিনি কী বলেছেন? একজন যদি পাঁচ কোটি দেয়, কেউ যদি সাড়ে পাঁচ কোটি দেয় তবে পাঁচ কোটি বাদ। যে সাড়ে পাঁচ কোটি দিবে সে আসো। এইভাবে তারা অকশন দিয়েছে। আপনারা বলেন, তারা কী রাজনীতি করে? আর আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে দেশের মানুষের উন্নয়ন হয়, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়।’
বিএনপি জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা-খুনের উদাহরণ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষ খুনের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত, মানি লন্ডারিংয়ের জন্য সাজাপ্রাপ্ত, দশট্রাক অস্ত্র মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি আজকে শরণার্থী হয়ে, বিদেশের মাটিতে বসে বাংলাদেশের ভেতরে ষড়যন্ত্র করছে। প্রধানমন্ত্রী তার ৩৩ মিনিটের বক্তব্যে সিলেটের উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘সিলেটে শ্রীহট্ট নামে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিচ্ছি। সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হবে। এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আগে চায়ের নিলাম শুধু চট্টগ্রামে হতো। আমরা সেই নিলাম সিলেটে যেন হয় সে ব্যবস্থা করে দিয়েছি। চা শ্রমিকেরা সবসময় নৌকায় ভোট দেয়। তাদের আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই, ধন্যবাদ জানাই। তাদের উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছি। তাদের মুজুরি বৃদ্ধি করেছি, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে সিলেটের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ চার জেলাতেই অন্তত একটি করে বিশ্ববিদ্যালয়- সেটা সরকারি বা বেসরকারি যাই হোক- করে দেব। সিলেট বিভাগ করেছি। সেই বিভাগের জন্য যা যা করা দরকার সব করে দিচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম। কারণ আমি দুর্নীতি করতে আসিনি। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে এসেছি, নিজের ভাগ্য না।
বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য গড়ে দেব। বাংলাদেশের মানুষের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে দেব এটাই ছিল লক্ষ্য। পরে এটা প্রমাণ হয়েছে, যে অভিযোগ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এনেছিল সব ভুয়া, বানোয়াট।
’প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কাজ করে যাচ্ছে। বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তারা ক্ষমতায় গিয়ে মানুষের সম্পদ লুটপাট করেছে, হত্যা-খুন করেছে, সন্ত্রাস করেছে, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করেছে। সারাদেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিত করিয়েছে। জঙ্গিবাদের দেশ হিসেবে পরিচয় করিয়েছে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মান ইজ্জত সব ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।’জনসভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সিলেট বিভাগের চার জেলার ১৯ আসনে মহাজোটের প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেন।
এসময়ে মহাজোটের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তখন উপস্থিত লাখো জনতা হাত তুলে মহাজোটের প্রার্থীদের বিজয়ী করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। পরে শেখ হাসিনা বলেন, নৌকা হচ্ছে মানুষের বিপদের বন্ধু। নূহ নবীর আমলে মহা-প্লাবনের হাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করেছিল এই নৌকা। নৌকায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছে স্বাধীনতা, মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার। দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আবারও নৌকা মার্কাকে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করুন। আগামীতে ক্ষমতায় আসলে দেশে দারিদ্র্য বলে কিছু থাকবে না।বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে সম্মান বাঙালি অর্জন করেছিল, তা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়। তবে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আমরা দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ শুরু করি।
২০০১ সালে বিদেশিদের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা ক্ষমতায় আসার পর দেশকে আবার পিছিয়ে দেয়। আমরা যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করি সব বন্ধ করে দেয়। শুরু করে একের পর এক মানুষ খুন, বোমা হামলা, জঙ্গিবাদ। কতো মানুষকে তারা হত্যা করেছে, পুড়িয়ে মেরেছে, লুটপাট করেছে। জঙ্গিবাদী দেশ হিসেবে পরিচয় করিয়েছে এ দেশকে। মান-সম্মান শেষ করে দিয়েছিল বিএনপি। তাদের অপকর্মের কারণে বিশ্ব দরবারে বাঙালির মাথা নত হয়ে আসে। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আবার দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করার কাজ শুরু করে।
২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই দশ বছরে আমরা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে পরিণত করেছি। বাংলাদেশ এখন বিশ্ব দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে।’আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ১৬০০ মেগাওয়াট থেকে শুরু করেছিলাম এখন ২০ হাজার মেগাওয়াট। যেখানে বিদ্যুৎ নেই সেখানে সোলার প্যানেল দিয়ে দিচ্ছি। প্রতিটি ঘরে ঘরে জ্বালবো বিদ্যুতের আলো— এই স্লোগান নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তার সরকারে উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার কোনো স্বীকৃতি ছিল না। সেটাকে আমরা মাস্টার ডিগ্রি সম্মান দিয়ে দিয়েছি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আমলের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যা করেছে বিএনপি। সেই বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন শাহ কিবরিয়ার ছেলে। এটা অত্যন্ত লজ্জার ও পরিতাপের বিষয়।সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লুত্ফুর রহমানের সভাপতিত্বে জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা, সুজিত রায় নন্দী, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
এছাড়া সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের প্রার্থীদের মধ্যে এ কে আব্দুল মোমেন, হাফিজ আহমদ মজুমদার, ইমরান আহমদ, মাহমুদ উস সামাদ কয়েস প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সমাবেশ পরিচালনা করেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী।