সিরিয়ায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন মোহাম্মদ আল বশির।
মঙ্গলবার সিরিয়ার টেলিভিশনে দেওয়া এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ এ সরকারসহ সিরিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
এদিকে প্রেসিডেন্ট আসাদের পতনের পর দুইদিনে ৩১০টি বিমান হামলা চালিয়ে সিরিয়ার সামরিক শক্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরাইল। খবর রয়টার্স, স্কাই নিউজ, আলজাজিরার।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন বিদ্রোহী জোটের প্রধান কমান্ডার আবু মোহাম্মদ আল জোলানি। তিনি একটি স্থিতিশীল প্রশাসন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন।
রয়টার্স জানিয়েছে, আল জোলানি ইতোমধ্যে আসাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ জালালি এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল মেকদাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো ও কার্যপ্রণালি নিয়ে মতবিনিময় হয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্রোহী নেতা মোহাম্মদ আল বশির অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারেন। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো দামেস্ক দখলের নেতৃত্বে ছিল হায়াত তাহরির আল শামস (এইচটিএস)।
সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে এইচটিএস পরিচালিত সিরিয়ান স্যালভেশন গভর্নমেন্টের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন ৪১ বছর বয়সি প্রকৌশলী মোহাম্মদ আল বশির। ১৯৮৩ সালে সিরিয়ার ইদলিবে জন্মগ্রহণকারী মোহাম্মদ আল বশির ২০০৭ সালে আলেপ্পো ইউনিভার্সিটি থেকে যোগাযোগ স্পেশালাইজেশনসহ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি সিরিয়ান গ্যাস কোম্পানিতে কাজ করেন।
সিরিয়ার বিদ্রোহের পর আল বশির ২০২১ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন এবং বাশার আল আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ইদলিবভিত্তিক স্যালভেশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার মেয়াদে ই-গভর্ন্যান্সের প্রসার, রিয়েল এস্টেট ফি হ্রাস এবং পরিকল্পনাসংক্রান্ত নিয়ম শিথিল করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারে তার নেতৃত্বে একটি স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।
সরকার গঠনের পরই অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হবে বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন, নির্বাসিত এবং বাস্তুচ্যুত সিরিয়ানদের পুনর্বাসন করাও হবে তাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। সাধারণ জনগণও এখন ভেবে পাচ্ছে না সিরিয়ার নতুন অন্তর্বর্তী সরকার আসলে কেমন হবে। কারণ, বিদ্রোহীদের মধ্যে বিভিন্ন উপ-গোষ্ঠীর মধ্যে চরম মতবিরোধ রয়েছে।
এসব মতবিরোধ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও উসকে দিতে পারে। এদিকে আসাদের পতনের পর মাত্র দুইদিনে ইসরাইলের চালানো ৩১০টির মতো হামলার কারণে সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা তছনছ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ সংশয় প্রকাশ করেছেন। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক স্যামুয়েল রামানি বলেছেন, বাশারের পতনে এইচটিএসের সঙ্গে যে কয়েকটি গোষ্ঠী ছিল, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ)।
ভিন্নমতের এ গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনে এইচটিএস কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, এইচটিএস ও এসএনএ-এর মধ্যে ২০২২ সালের আগে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে।
বিদ্রোহী জোট এখনো সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা প্রকাশ করেনি। এমন একটি অঞ্চলে এ ধরনের ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো নির্দিষ্ট মডেলও নেই। সোমবার দামেস্কে কিছু বিদ্রোহী যোদ্ধা আশা প্রকাশ করেছেন, শিগ্গিরই একটি নাগরিক প্রশাসন দেশ পরিচালনা করবে।
ইদলিব প্রদেশের যোদ্ধা ফেরদৌস ওমর বলেন, ‘আমরা চাই রাষ্ট্র এবং নিরাপত্তা বাহিনী যেন ক্ষমতায় থাকে।’ ফেরদৌস শিগ্গির নিজের আদি পেশা কৃষিকাজে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষক লাহিব হিগালও। নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেছেন, নতুন সরকার গঠনের পর তারা সিরিয়ার অন্য গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থরক্ষায় কীভাবে ভারসাম্য আনবে এবং কীভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতনভাতা দেবে-এসব বিষয় পরিষ্কার নয়। সিরিয়ায় ইরাকের মতো পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন লাহিব হিগাল।
এমন পরিস্থিতিতে সিরিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি রূপরেখা দিয়েছে কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থান করা বাশারবিরোধী জোট সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশন।
জোটের প্রধান হাদি আল বাহরা রয়টার্সকে বলেছেন, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ১৮ মাসের অন্তর্বর্তী সময় প্রয়োজন। এছাড়া ছয় মাসের মধ্যে একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করতে হবে। সিরিয়ায় শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে চীন, ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশও।