রাজবাড়ীতে পদ্মা সেতু নিয়ে গুজব ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে রাজবাড়ী পুলিশ। এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার আসমা সিদ্দিকা মিলি বলেন, সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে ১৫ দিনের ব্যবধানে তিন নারী ও এক শিশুকে গলাকেটে হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। এসব খুনের ঘটনায় রাজবাড়ীতে পদ্মা সেতু নিয়ে যে গুজব ছড়ানো হয়েছে তা ভিত্তিহীন।
রোববার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার এসব কথা বলেন।
আসমা সিদ্দিকা মিলি বলেন, সামনের দিনগুলো আরও কঠিন হবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে কেউ যেন এ রকম আর কোনো গুজব ছড়াতে না পারে সে জন্য সাংবাদিকদের সজাগ থাকার অনুরোধ জানান।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার বলেন, আগস্ট মাসে ১৫ দিনের ব্যবধানে রাজবাড়ী সদর উপজেলার পাশাপাশি তিনটি ইউনিয়নে (মুলঘর, আলীপুর ও বানীবহ) তিন নারী ও এক শিশুকে গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এরপর থেকে ওইসব এলাকায় নানা ধরণের গুজব ছড়াতে থাকে।
শুরুতে পুলিশ বিষয়টি আমল না দেয়ায় গুজব ডালপালা মেলে আরও ছড়িয়ে যায়। অনেকেই গলাকাটা আতঙ্কে এলাকায় পাহারা দিতে শুরু করে। অবশেষে আমরা হত্যাগুলোর রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছি।
পুলিশ সুপার বলেন, গত ১৬ আগস্ট দিনগত রাতে সদর উপজেলার আলীপুর ইউনিয়নের বারবাকপুর গ্রামে হাজেরা বেগম (৪৮) নামে এক নারীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের স্বামী তমিজউদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামি করে রাজবাড়ী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। একমাস ধরে এই হত্যা মামলা তদন্ত করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এসপি বলেন, তদন্তে আমরা জানতে পারি ওই গৃহবধূর ছেলে হাফিজুল প্রবাসে থাকেন। হাফিজুলের স্ত্রী স্বপ্না বেগমকে (২৫) অনেক ভালোবাসতেন তার মা হাজেরা বেগম। এ কারণে হাজেরা মাঝেমধ্যেই ছেলের বউয়ের কাছে ঘুমাতেন। কিন্তু ছেলের বউ স্বপ্নার পরকীয়া সম্পর্ক ছিল স্থানীয় সোহেল মিয়া নামে এক যুবকের সঙ্গে।
রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার বলেন, ঘটনার দিন রাতে সোহেল তার সহযোগী কবির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে স্বপ্নার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হতে আসে। এসময় স্বপ্না ও তার চার বছর বয়সী ছেলে সানী এবং শাশুড়ি হাজেরা একই বিছানায় শুয়েছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ছেলের বউয়ের পরকীয়া সম্পর্ক দেখে ফেলেন হাজেরা। আর এতেই সোহেল, কবির ও স্বপ্না মিলে গলাকেটে হত্যা করে হাজেরাকে। শুধু তাই নয়, কেউ যাতে স্বপ্নাকে সন্দেহ করতে না পারে এজন্য সোহেল স্বপ্নার দুই হাতে কোপ দিয়ে জখম করে দিয়ে যায়।
পুলিশ সুপার বলেন, হত্যাকাণ্ডের পরদিন সকালে হাজেরার লাশ উদ্ধারের পাশাপাশি তার ছেলের বউ স্বপ্নাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়। ওইসময় মিথ্যা নাটক সাজিয়ে স্বপ্না জানান, ওইদিন রাতে খাবার খেয়ে সে তার ছেলেসহ শাশুড়ি একই ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তিনি দেখতে পান ঘরের আলো নেভানো এবং তার শাশুড়ির শরীরে রক্ত। এসময় তিনি চিৎকার দিলে পাশের ঘরে থাকা শ্বশুরসহ অন্যান্যরা ছুটে এসে দেখেন হাজেরা বেগমের গলাকাটা লাশটি খাটের ওপর পড়ে আছে।
কিন্তু গত ৭ সেপ্টেম্বর হত্যার মূলহোতা সোহেল ও তার সহযোগী কবিরকে গ্রেফতার এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি উদ্ধার করা হয়। পরে শনিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) নিজের শাশুড়িকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন স্বপ্না।
এর আগে ৭ আগস্ট দিনগত রাতে সদর উপজেলার বানীবহ ইউনিয়নের আটদাপুনিয়া গ্রামে নিজ বসত ঘরে দুই সন্তানের জননী গৃহবধূ আদুরী আক্তার লিমাকে (২৫) গলাকেটে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পরদিন গত ৮ আগস্ট নিহতের স্বামী রড মিস্ত্রি মিজানুর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামি করে রাজবাড়ী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এ হত্যার বিষয়ে পুলিশ সুপার আসমা সিদ্দিকা মিলি বলেন, পিলার থেকে ম্যাগনেট সংগ্রহ চক্রের সদস্য ছিলেন আদুরী বেগম। তার আপন দুই দেবর এবং এক ফুফাতো দেবরও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই ম্যাগনেট ব্যবসার দ্বন্দের কারণেই তিন দেবর মিলে গলাকেটে হত্যা করে আদুরীকে। আদুরীর তিন দেবর বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে। তারা পুলিশের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করেছে।
এছাড়া গত ২ আগস্ট দিনগত রাতে রাজবাড়ী সদর উপজেলার মুলঘর ইউনিয়নের পশ্চিম মুলঘর গ্রামে দাদী শাহিদা বেগম (৪৫) ও নাতনী লামিয়া আক্তারকে (৭) গলা কেটে হত্যা করা হয়। জোড়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৩ আগস্ট নিহত শিশু লামিয়ার বাবা গার্মেন্টেস কর্মী শহিদুল ইসলাম (৩২) বাদী হয়ে রাজবাড়ী সদর থানায় অজ্ঞাত আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন।
এ হত্যার বিষয়ে সংবাদিক সম্মেলনে পুলিশ সুপার বলেন, দাদি-নাতনি হত্যার ঘটনায় আসামি গ্রেফতার রয়েছে। এ হত্যার রহস্যটিও আমরা ইতিমধ্যে উদঘাটন করেছি। কিন্তু, আমাদের কিছু টেকনিক্যাল বিষয় আছে। আশা করছি ওই বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে শিগগিরই এ হত্যার বিষয়ে আপনাদের জানাতে পারবো।
সাংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার আসমা সিদ্দিকা মিলি ছাড়াও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাকিব খাঁন, সিনিয়ন সহকারী পুলিশ সুপার (পাংশা সার্কেল) মো. ফজলুল করিম, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি মো. কামাল হোসেন ভূইয়া ও পরিদর্শক মো. জিয়ারুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।