আসন্ন নির্বাচনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে সেনাবাহিনী। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯ ও ১৩০ ধারা অনুযায়ী। এবার মোতায়েন করা হচ্ছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৭, ১২৮, ১২৯, ১৩০, ১৩১ ও ১৩২ ধারায়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯ থেকে ১৩২ ধারার মধ্যে ১৩১ ধারায় সেনাবাহিনীর কোনো কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারকে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুপস্থিতিতেও জননিরাপত্তা বিপদগ্রস্ত হওয়ার মতো সমাবেশ ভঙ্গ করার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া আছে।
ইসির খসড়া পরিপত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক সভার পর নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বৃহস্পতিবার ওই বৈঠক হয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে তৃতীয় কোনো শক্তির ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও এ বিষয়ে সতর্ক নজরদারি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গতকাল আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক সমন্বয় সভায় সিইসি ওই নির্দেশ ও পরামর্শ দেন।
সভায় বক্তব্যে সিইসি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে কি না, তা-ও নজরে রাখতে বলেন। ২০১৪ সালের সহিংস অবস্থার কথা মাথায় রেখে নিরাপত্তার ছক তৈরি করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেন তিনি।
ইসির আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক সভার কার্যপত্রে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভোটগ্রহণের আগে, ভোটগ্রহণের দিন ও পরে শান্তি-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার জন্য ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ থেকে ১ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখ পর্যন্ত (যাতায়াত সময় ব্যতীত) সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগের জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে এরই মধ্যে অনুরোধ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখ হতে নির্বাচনী এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থা, ভৌত অবকাঠামো এবং নির্বাচনী পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য প্রতি জেলায় সশস্ত্র বাহিনীর ছোট আকারের টিম পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সশস্ত্র বাহিনীর দায়িত্ব পালন সম্পর্কে কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ‘(ক) সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যগণ প্রতিটি জেলা/উপজেলা/মেট্রোপলিটন এলাকার নোডাল পয়েন্ট এবং অন্যান্য সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান করে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত থাকবে। (খ) রিটার্নিং অফিসারের সাথে সমন্বয় করে প্রয়োজন অনুসারে উপজেলা/থানায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োগ করা হবে। (গ) রিটার্নিং অফিসার সহায়তা কামনা করলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহায়তা প্রদান অথবা ফৌজদারি কার্যবিধির, অন্যান্য আইনের বিধান ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা নির্দেশনা অনুসারে সশস্ত্র বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। (ঘ) রিটার্নিং অফিসার বা প্রিসাইডিং অফিসারের চাহিদা ব্যতিরেকে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরে কিংবা ভোট গণনা কক্ষে কোনো প্রকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে না। (ঙ) ইনস্ট্রাকশন রিগার্ডিং এইড টু দি সিভিল পাওয়ার এবং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। (চ) উপকূলবর্তী এলাকায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নৌবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। (ছ) ঝুঁকি বিবেচনায় প্রতিটি জেলায় নিয়োজিত সেনা সদস্যের সংখ্যা রিটার্নিং অফিসারের সাথে সমন্বয় করে কমবেশি করা যাবে। (জ) সেনা সদরের বিবেচনায় প্রতিটি স্তরে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সেনা সদস্য সংরক্ষিত হিসেবে মোতায়েন থাকবে। (ঝ) গুরুত্বপূর্ণ সড়ক/মহাসড়কসমূহের নিরাপদ যান চলাচল এবং স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করবে।
এতে আরো বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনী এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনী তাদের আওতাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার মধ্যে যেসব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হবে, সেসব কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এ ছাড়া ইভিএম কেন্দ্রে যেসব সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য থাকবে তাদের নিরাপত্তা বিধানসহ প্রয়োজন অনুসারে আনুষঙ্গিক বিষয়াদির ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। (ণ) নির্বাচনী এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীর টিম ওই ছয়টি নির্বাচনী এলাকায় ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণসংক্রান্ত নিরাপত্তা বিধানে নিবিড় ও অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে। (ত) রিটার্নিং অফিসার ও প্রিসাইডিং অফিসারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে দায়িত্ব পালন করবে।’
জানা যায়, গত বছর ২৪ অক্টোবর ইসির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৩১ ধারায় সেনা নিয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সংলাপে কয়েকজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯ থেকে ১৩০ ধারায় এবং সেনা বিধিমালা ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেটের আওতায় সেনাবাহিনী মোতায়েনে কোনো কাজ হবে না। এ ছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনে ইসি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৩১ ধারা অনুসারে সেনাবাহিনী নিয়োগ করলে কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় ওই বাহিনী অনিয়ম রোধে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। ওই সময় একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল, ইসি সেনাবাহিনীকে ‘ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল ক্ষমতা’ দিয়েছে। এর জবাবে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ইসি সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘উপজেলা নির্বাচনে কমিশন সশস্ত্র বাহিনী বা সেনাবাহিনীকে ম্যাজেস্ট্রিয়াল বা বিচারিক ক্ষমতা দেয়নি। এ নির্বাচনে কোনো সহিংসতা রোধে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্ট্রাইকিং হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি নির্বাচনী এলাকায় দৃশ্যমান করার জন্য নির্বাচন কমিশন বিশেষভাবে নির্দেশনা প্রদান করে। এ নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো প্রকার দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নজরে আসামাত্র সংশ্লিষ্ট সামরিক কর্মকর্তা দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (ফৌজদারি কার্যবিধি), ১৮৯৮-এর ধারা ১৩১ অনুসারে তাত্ক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে মর্মে আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনকে জানিয়ে দেওয়া হয়।’
ফৌজদারি কর্যবিধির ১৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যখন এইরূপ কোনো সমাবেশ দ্বারা জননিরাপত্তা সুস্পষ্টভাবে বিপদগ্রস্ত হয় এবং কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায় না, তখন সেনাবাহিনীর কোনো কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এইরূপ সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে পারেন এবং এইরূপ ছত্রভঙ্গ করার অথবা আইনানুসারে শাস্তি দেওয়ার জন্য ওই সমাবেশে অংশগ্রহণকারী কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার বা আটক করতে পারেন। তবে এই ধারা অনুসারে কাজ করার সময় তাঁর পক্ষে যদি কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়, তাহলে তিনি (কমিশনপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার) তা করবেন এবং অতঃপর কাজ চালিয়ে যাওয়া না বা না যাওয়া সম্পর্কে তাঁর (ম্যাজিস্ট্রেটের) পরামর্শ অনুসরণ করবেন।