অনলাইন ডেস্ক:
মির্জাপুর পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিল আব্দুর রাজ্জাক যখন একজন চা বিক্রেতা। তিনি ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয় ও সৎ হিসেবে পরিচিত এই কাউন্সিলরের প্রশংসা সবার মুখে মুখে।
তিনি একজন জনপ্রতিনিধি। তিনি মির্জাপুর পৌরসভার নির্বাচিত কাউন্সিলর। কিন্তু চালাচ্ছেন চা-দোকান। নিজেই চা বানিয়ে বিক্রি করছেন। এখানে সাধারণ মানুষ আসেন নানা সমস্যা নিয়ে। চায়ের দোকানে বসেই সেগুলো সেরে দেন। নিজের সিল-প্যাড রাখা থাকে দোকানে। অফিসিয়াল কাজকর্মও এখানেই সারেন।
কাউন্সিলর আব্দুর রাজ্জাকের চা দোকানের ৫০ গজ দূরে মির্জাপুর পৌরসভা কার্যালয়। পৌরসভা কার্যালয়ে এলাকার নাগরিকদের কোনো কাজ থাকলে দোকান ফেলে ছুটে যান অফিসে। তার ব্যক্তিগত সিলপ্যাড থাকে চা স্টলেই।
আব্দুর রাজ্জাকের বাবার নাম নাজিম উদ্দিন মিয়া। তারা পাঁচ ভাইবোন। ভাইদের মধ্যে কাউন্সিলর আব্দুর রাজ্জাক বড়। ১৯৯৬ সালে এসএসসি পাস করে মির্জাপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হলেও সাংসারিক কারণে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া হয়নি তার।
আব্দুর রাজ্জাকের বড় দুই বোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। মেজভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার করেছেন। ছোট ভাই মা-বাবা ও স্ত্রী কন্যা নিয়ে তাদের সংসার। জমি-জমা তেমন না থাকলেও আবাদ করলে সারা বছরের সংসারের খাবারের সংস্থান হয়। তার পিতা নাজিম উদ্দিন এক সময় ইটভাটার শ্রমিক সরবরাহের কাজ করতেন। কিন্তু বয়সের কারণে ওই কাজ ছেড়ে দিয়ে বাড়ির পাশে উপজেলা প্রশাসনের মসজিদের পাশে একটি চায়ের গুনটি দোকান দেন কয়েক বছর আগে। ছোট ভাইয়ের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপের দোকান আছে। অর্থবিত্ত না থাকলেও অভাব নেই তাদের।
মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান আব্দুর রাজ্জাক ২০০৩ সালে সংসার জীবন শুরু করেন। তার এক মেয়ে দৃষ্টিমণি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। আর ছেলে আব্দুর রহমান সানির শিশু শ্রেণীর ছাত্র।
ছাত্রজীবন থেকেই এলাকাবাসীর কাছে অত্যন্ত ভদ্র ও সদালাপী হিসেবে পরিচিত আব্দুর রাজ্জাক মানুষের বিপদ-আপদের খবর শুনলেই ছুটে গিয়ে পাশে দাঁড়াতেন। কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতেন। সামাজিক কাজকর্মে অংশ নিতেন। আর সে কারণে এলাকার মানুষও তার কর্মের প্রতিদান হিসেবে তাকে নির্বাচিত করেছেন তাদের প্রতিনিধি হিসেবে। নির্বাচনে তেমন টাকা-পয়সা খরচ করতে না পারলেও বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন তিনি।
তবে কাউন্সিলর নির্বাচিত হলেও আচার আচরণ, কথাবার্তা ও চালচলনে কোনো পরিবর্তন নেই আব্দুর রাজ্জাকের। তিনি সব সময় অতি সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করেন। নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পর তার বাবার শরীর বেশি খারাপ হয়ে পড়লে চায়ের দোকানে বসেন কাউন্সিলর নিজেই। গত প্রায় তিন বছর ধরে প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই গুনটি দোকানে বসে নিজ হাতে যত্ন সহকারে চা তৈরি করে তা ক্রেতাদের মাঝে পরিবেশন করেন। এর মধ্যে অনেক ক্রেতাকে বিনামূল্যেও চা পান করিয়ে থাকেন। অপরিচিত অনেক ক্রেতা চা খাওয়ার পর পরিচয় জানতে
পেয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। অনেক ক্রেতা পক্ষে-বিপক্ষে নানা মন্তব্যও করে থাকেন। তবে কাউন্সিলর আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন তিনি কাজ করছেন। কোনো খারাপ কিছু করছেন না। কোনো কাজকে অবহেলা করা ঠিক নয়। দোকান করার পাশাপাশি এলাকাবাসীর সমস্যার কথা শুনে তা সমাধানও করে থাকেন চা দোকানে বসে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে পাওয়া যায় চা দোকানে।
বাইমহাটি প্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান মাস্টার বলেন, আমাদের দেশে তো জনপ্রতিনিধি মানে বিরাট ব্যাপার স্যাপার। কোনো একটি পদ পদবি পেলে তার আগে পেছনে হুমরা-চুমরা থাকে। কিন্তু কাউন্সিলর রাজ্জাক জনপ্রতিনিধি হয়েও যেভাবে একজন সাধারণ চা দোকানির মতো সারাদিন চা বিক্রি করেন তা প্রশংসার দাবি রাখে।
আব্দুর রাজ্জাক জানান, প্রতিদিন ১৫০০ থেকে দুই হাজার টাকার চা-পান বিক্রি হয়ে থাকে। তা থেকে যা লাভ হয় তা দিয়ে কোনো মতে চলে যায়।
তার মতে টাকা- পয়সায় সুখ আসে না। মানুষের ভালোবাসায় প্রকৃত সুখ পাওয়া যায়।
মির্জাপুর পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমিরুল কাদের লাবন বলেন, তিনি নিসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। একজন কাউন্সিলর হওয়া সত্ত্বেও চা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে এমন ঘটনা নজির বিহীন।
মির্জাপুর পৌরসভার মেয়র সাহাদৎ হোসেন সুমন এই কাউন্সিলরের প্রশংসা করে বলেন, তিনি (কাউন্সিলর আব্দুর রাজ্জাক) খুবই ভালো একজন মানুষ। তার মধ্যে কোনো অহংকার ও হিংসা প্রতিহিংসা নেই। তিনি তার কথা ও ব্যবহারে সবাইকে অতি সহজে আপন করে নিতে পারেন।