26 C
Dhaka
এপ্রিল ৩০, ২০২৫
Bangla Online News Banglarmukh24.com
ইসলাম প্রচ্ছদ

অন্তিম শয়ানে বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী নিজ সন্তানদের যা বলেছিলেন

মধ্যযুগের বিশ্বখ্যাত বাগদাদ নগরীতে পৌঁছে হযরত আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি নিজেকে জ্ঞানসাগরে নিমগ্ন করলেন এবং ভর্তি হলেন বিখ্যাত নিযামিয়া মাদ্রাসায়। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে মনোবলের সাথে তাঁর জ্ঞান-আহরণের ধারা শুরু হলো। প্রখর ধীশক্তি সম্পন্ন মেধা, অনুশীলনের গভীর মনোযোগের কারণে অল্পদিনের মধ্যে তিনি মাদ্রাসার শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ক্বোরআন, হাদীস, ফিক্বাহ্, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন ও বিজ্ঞানসহ তেরটি বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। চরম আর্থিক সংকটের মধ্যেও তাঁর লেখাপড়া এগিয়ে চলছিল। মায়ের দেয়া চল্লিশটি স্বর্ণ-দিনার ক্রমে নিঃশেষ হয়ে গেল। বিশেষ করে সহপাঠী বন্ধু ও মানুষের অভাব দেখে তাঁর অন্তর বিগলিত হয়ে যেত এতে করে তাঁর আনীত অর্থ বিলিয়ে দেওয়ায় সহসা ফুরিয়ে যায়। ছাত্রাবস্থায় তাঁকে অর্ধাহারে, অনাহারে ও নিদারুণ কষ্টের মধ্যে কালাতিপাত করতে হতো। এরূপ বিরূপ পরিস্থিতিতে তিনি স্বীয় অধ্যয়ন কাজে কখনো বিচ্যুতি ঘটাননি। সর্বোপরি আল্লাহর উপর একান্ত নির্ভরশীলতা তাঁর সাধনার পথকে আরো সহজতর করে তুলেছিল।

তৎকালিন বাগদাদের প্রখ্যাত শিক্ষকমণ্ডলীর কাছে তিনি জ্ঞান আহরণ করেন। হযরত আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। অতি অল্প সময়ে তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে অগাধ-গভীর জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হন। তাঁর আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞানের গভীরতা দেখে নিযামিয়া মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক সবাই অভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁর জ্ঞানের খনি বা ভাণ্ডার অমূল্য তত্ত্বজ্ঞানে সমৃদ্ধ। একটানা মনযোগের সঙ্গে আঠারো বছর পরিশ্রম করে তখনকার বাগদাদে প্রচলিত সকল শাস্ত্রে তিনি ব্যুৎপত্তি ও পাণ্ডিত্য লাভ করেন।

শিক্ষার্থী অবস্থায় তিনি অনেক দরবেশ ও কামেল অলির দরবারে উপস্থিত হয়ে ফয়জ ও বরকত হাসিল করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ না করে আধ্যাত্মিক সাধনার পথ বেছে নেন- এ জীবন পথে তিনি সঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়াতেন। আধ্যাত্মিক সাধনার পথ সুপ্রশস্ত করার জন্য এবং তত্ত্বজ্ঞানের মর্ম অনুধাবনের নিমিত্তে তিনি তখনকার তরীক্বতের শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ শেখ আবূ সাঈদ মাখযূমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন। অনেক দিন পীরের সান্নিধ্যে থেকে মারেফাত ও তরীক্বতের শিক্ষা নিয়ে পীরের আদেশেই তিনি সেই স্থান থেকে বিদায় নেন। পীরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি আরো কঠোর সাধনা ও রিয়াজতে নিমগ্ন হন। শহর ছেড়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়ে, বনের শাক-পাতা বনজ ফল মূল আহার করে তাঁর চলে যেতো। তাঁর চলা-ফেরা, পানাহার, চিন্তা-ভাবনা, ইবাদত-বন্দেগী আল্লাহর রেজামন্দীর নূরে আলোকিত হয়ে উঠল। তিনি তাওয়াক্কুলের চরমশীর্ষে আরোহন করেন। তিনি আল্লাহর ইশক্বে ফানাফিল্লাহ্র উত্তাল তরঙ্গমালার উপর ভেসে বেড়াতে লাগলেন। রিয়াজতের সময় তিনি দীর্ঘদিন মরুভূমিতে বিচরণ করেছেন। কঠোর কৃচ্ছতা সাধনায় তিনি বছরের পর বছর কাটিয়ে দেন।

মৃত প্রায় ইসলামকে নতুন জীবন দেয়াই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো। মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রচারিত ধর্ম যখন প্রায় জরাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল তখন তাতে নতুন সঞ্জীবনী শক্তি দান করাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে তিনি সফলও হন। এজন্য তাঁকে বলা হতো ‘মুহিউদ্দীন’।

হযরত শেখ আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর মাতা উম্মুল খায়র সাইয়্যেদা ফাতেমা সানি আনুমানিক বিরাশি বছর বয়সে জিলানের নেইফে ইন্তেক্বাল করেন। সে সময় বড়পীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি নিযামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বাগদাদ গমনের পর মায়াময়ী জননীর সাথে আর দেখা হয়নি।

তাঁর কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর পীর নিযামিয়া মাদ্রাসার খ্যাতনামা শিক্ষক পীরে কামেল হযরত আবূ সাঈদ মোবারক মাখযূমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর বাবুল আযম মাদ্রাসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি শিক্ষকতার পথে এগিয়ে যান। এই মাদ্রাসা বিপুল সমারোহে গড়ে উঠলে নতুন আঙ্গিকে এই মাদ্রাসার নামকরণ করা হয় ‘মাদ্রাসায়ে ক্বাদেরিয়া’। এ মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা লাভ করে স্বনামধন্য শিক্ষার্থীরা সারা পৃথিবীতে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলেছিলেন।

বাগদাদে স্থায়ীভাবে বসবাসের পর তিনি শুধু মাদ্রাসার কাজে ব্যস্ত না থেকে প্রচুর দর্শনার্থীর মাঝে ওয়াজ মাহফিলে মূল্যবান বক্তব্য দিতে লাগলেন। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় ৫২১ হিজরির ১৬ শাওয়াল দিবাগত রাত্রে হযরত বড়পীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাক্ষাৎ পেলেন। তিনি তাঁকে বললেন, ‘ইয়া আবদুল ক্বাদের! লিমা লা-তাতাকাল্লামু? অর্থাৎ ‘হে আবদুল ক্বাদের! তুমি জনসধারণের মাঝে কেন বক্তৃতা প্রদান করছ না।’ জনসমক্ষে তাঁর বক্তৃতা প্রদানের অক্ষমতার কথা জানালে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এই আয়াতটি সাতবার পাঠ করে তার মুখে দম করলেন, ‘উদ‘ঊ ইলা- সাবিলী রাব্বিকা বিল হিকমাতি ওয়াল মাউ‘ইজাতিল হাছানাতি’। অর্থাৎ প্রজ্ঞা ও মননশীলতা এবং উত্তম উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করতে থাকো।’ যে রাত্রে তিনি নতুন নির্দেশ পেলেন তারপর দিন যোহরের পর মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে জনসমক্ষে বক্তৃতা শুরু করলেন। ক্রমান্বয়ে দ্রুত বেশী লোক সমাগম হতে লাগলো। বাধ্য হয়ে বাগদাদের বিশাল ঈদগাহে মঞ্চ তৈরি করে সপ্তাহে তিনদিন জুমার দিন- সকালে, মঙ্গলবার বিকেলে ও রোববার সকালে ওয়াজ মাহফিলের ব্যবস্থা হলো। তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য ইরাকের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ থেকে পুণ্যার্থীরা আসতে লাগলো। তাঁর ওয়াজ মাহফিলে সমাজের বিভিন্ন ধরনের লোকের সমাগম হতো। তাঁর জ্ঞানগর্ভ তত্ত্বমূলক বক্তৃতাবলী পথহারা মানুষকে পথের দিশা দেখালো। আল্লাহর প্রেমের শাশ্বত স্রোতের তরঙ্গে মানুষের মন হিল্লোলিত হতো, শান্তির প্রস্রবণ বয়ে যেতো। তাঁর এই ক্বুদরতী বক্তৃতার ধারা লাখো লাখো উপস্থিত শ্রোতা সামনে পেছনে সমানভাবে সুললিত কন্ঠে শুনতে পেতো, অথচ তখন কোন মাইকের ব্যবস্থা ছিল না।

হযরত আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর নিয়ম নীতি ছিল ওয়াজ আরম্ভ করার পূর্বে সংক্ষিপ্ত আকারে খোতবা পাঠ করতেন। তাঁর জুমার নামাযের খোতবা ছিল অনন্য বৈশিষ্ট্যে ভরপুর। বড়পীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর খোতবা সম্পর্কে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ আবদুল ওয়াহাব রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেনে, ‘আমার বুযর্গ ওয়ালেদ ওয়াজের পূর্বে খোতবা আরম্ভ করতেন, ‘আল্ হামদুল্লিাহি রাব্বিল আলামীন’ তিনবার উচ্চারণ করে একটু নীরব থেকে খোতবা প্রদান শুরু করতেন। তাঁর মূল্যবান খোতবাসমূহ মানব মনে নবপ্রেরণার সৃষ্টি করে ধর্মীয় ও পার্থিব জীবনে আলোর পথের দিশা দেখাতো।’

বিভিন্ন গুণীজনের কাছে নানা সময়ে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষায় পত্রালাপ করতেন যার সংখ্যা কয়েক হাজার। এগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হলে কয়েক ভলিয়ম বই করা যেতো। অলিকুল শিরমণি হযরত আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হ্-িএর সারাটা জীবন ছিল নসীহতের অমূল্য আধার। তাঁর পবিত্র মুখ-নিঃসৃত প্রতিটি অমূল্য বাণী, ওয়াজ-নসীহত, দুর্লভ জ্ঞান সম্পদ খুবই অমূল্য ছিল, যার কোন তুলনাই হয় না। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নানা বিষয়ে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন তার তাৎপর্য চিরকাল অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর মূল্যবান উপদেশবাণী দিশেহারা মানুষকে নতুন পথের দিশা দেখিয়েছে। মৃত প্রায় ইসলামকে তিনি পুনরুজ্জীবিত করেছেন।

হযরত আবদুর ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর মহান কর্মময় জীবন ছিল মানবজাতির জন্য প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মানব জীবনের এমন কোন দিক নেই- যাতে তাঁর বহুমাত্রিক কর্মজীবনের আদর্শ ফুটে উঠেনি। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের সাথে তাঁর আদর্শিক মিল ছিল। তিনি মানব সমাজের কল্যাণ ও পরিশুদ্ধতার জন্য আজীবন সাধনা করে গেছেন। তাঁর সাধনা ছিল অত্যন্ত কঠোর- যা দুনিয়া ও আখিরাতের মঙ্গল বয়ে এনেছে, তাঁকে নিয়ে গেছে আল্লাহ্ পাকের একান্ত সান্নিধ্যে। সারাজীবন কর্মব্যস্ততার মাঝেও তিনি ইসলামি তত্ত্বমূলক মূল্যবান গ্রন্থাদি রচনা করেছেন তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী হলো – ১. গুনিয়াতুতত্বালেবীন, ২. ফতহুল গায়ব, ৩. ফাতহে রব্বানী, ৪. ফাওয়াজে ইয়াজদানী, ৫. ক্বাসিদাতুল গাউসিয়া (উচ্চমানের কাব্যগ্রন্থ), ৬. দীওয়ান (ফারসি কাব্যগ্রন্থ), ৭. হাশত্ বাশায়েরুল খেরাত, ৮. জালালুল খতির, ৯. র্সিরুল আসরার, ১০. তাফসিরে ক্বোরআনুল করীম, ১১. মাকতুবাতে গাউসিয়া।

তাছাড়া তাঁর জীবনে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে, খোতবায় ও অন্যান্য সমাবেশে অসংখ্য মূল্যবান বক্তব্য প্রদান করেছেন, যা যথাযথ লিপিবদ্ধ হয়নি। তাঁর অনেক লেখাও গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়নি। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ তীক্ষ প্রতিভাবান লেখক।

আল্লাহর নবী বা রাসূলগণ কর্তৃক সংঘটিত অলৌকিক কার্যাবলীকে মুজেযাহ্ এবং বুযর্গ অলিদের দ্বারা এ ধরনের সংঘটিত ঘটনাবলীকে কারামত বলে। অলিকুল শিরোমণি হযরত আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর সারা জীবন অনন্য সাধনা ও অপূর্ব কেরামতে ভরপুর। তাঁর জীবনের প্রারম্ভ থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত অনেক কারামত সংঘটিত হয়েছে। অলিশ্রেষ্ঠ হিসেবে তাঁর মতো আর কোন অলির জীবনে এত অধিক কারামত প্রকাশ হয়নি। তাঁর জীবনে অগাধ সমুদ্ররাজির মতো কারামত সংঘটিত হয়েছে।

ইলমে শরিয়ত ও ইলমে তরিকত পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। আল্লাহ্ পাকের সান্নিধ্য লাভের জন্য দু’টি পদ্ধতি আন্তরিকভাবে ধারণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বড়পীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ‘তোমরা প্রথমেই ইলমে শরিয়তের জ্ঞান অর্জন করো, তারপরে নির্জনতার পথ বেছে নাও। জ্ঞানহীন ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদতে অজ্ঞানবশত লিপ্ত হয়- যাতে প্রকৃত সফলতা আসে না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তাদের এ ধরনের ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়। প্রথমে শরিয়তের জ্ঞানে নিজেকে আলোকিত করে, পরে আল্লাহ্র দিদারের জন্য জিকির-আজকারে মনেনিবেশ করো। যে ব্যক্তি শরিয়ত অনুযায়ী আমল করে আল্লাহ্ তাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই বাতেনী জ্ঞান দান করেন। শরিয়তের দৃষ্টিতে সকল প্রকারের মন্দ কাজকে পরিহার করে ভালো কাজকে গ্রহণ করাটাই হলো তাক্বওয়া বা পরহেজগারী। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা নিজেদের অন্তরকে এমনভাবে প্রহরা অবস্থায় রাখ- যাতে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কেউ স্থান না পায়।’ হযরত আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি পীর-মুর্শিদের জন্য ৫টি গুণের সমন্বয়ের কথা বলেছেন, তা হলো:

১. পীর-মুর্শিদকে শরিয়ত বিষয়ে একজন পরিপূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন আলেম হতে হবে;২. ইলমে হাক্বীক্বত সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞানের অধিকারী হতে হবে; ৩. প্রত্যেক লোকের সাথে মার্জিত, ভদ্র-নম্র ও সদাচারণ করতে হবে; ৪. দীন-হীন, দরিদ্র, অসহায় ব্যক্তিদের সাথে সদ্ব্যবহার ও সহানুভূতিশীল হতে হবে; ৫. ভক্ত-মুরীদদের অন্তরের রোগ ও মন্দস্বভাব দূরীভূত করতে সক্ষম হতে হবে। পীরকে নিজে রিয়া, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, গর্ব-গরিমা, কর্তব্যকাজে শিথিল হলে চলবে না। আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস, চাকচিক্য-জৌলুস, স্বার্থপরতা পরিহার করে সহজ সরল, সাদাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে হবে।

হযরত আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর তরীকা হলো ক্বোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক। তিনি নিজের ব্যাপারেও খুবই কঠোর সাধনা, ইবাদত-বন্দেগী, জিকির-আজকারে মশগুল থাকাকে পছন্দ করতেন। আল্লাহকে ভয় এবং গুনাহ্ থেকে মুক্ত থাকার জন্য সবাইকে উপদেশ দিতেন। হযরত শায়খ আবু সাঈদ ক্বাইলুলি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর ব্যাপারে বলেন, ‘হযরত শেখ আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর স্থানে হলো আল্লাহ্র একান্ত সান্নিধ্যে এবং তাঁর যাতে পাকের সাথে সম্পর্কিত। তিনি এমন একজন উচুঁ মর্যাদার অধিকারী- যার ধারে-কাছে যাওয়াটাও সহজসাধ্য নয়। তিনি মারেফাতের উচ্চতম স্থানে অবস্থান করায় তিনি গাউসুল আযম অর্থাৎ অলিকুল শিরোমণি ছিলেন। তাঁরাও সবসময় গাউসে পাকের দরবারে হাজির হতেন এবং তাঁর রূহানী তাওয়াজ্জুহ্ হাসিল করতেন। দেশ-বিদেশের অলি-বুযুর্গগণ তাকে শ্রদ্ধাভরে সর্বশ্রেষ্ঠ অলি ও গাউসুল আযম হিসেবে মান্য করতেন।

অলিকুল শিরোমণি হযরত আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর জীবন ছিল কর্মবহুল ও গৌরবগাঁথায় ভরপুর। অবসর মোটেই ছিল না, সময়ের অপচয় না করে প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি কাজে লাগাতেন। হযরত বপড়ীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর আদর্শ, ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিরলস সাধনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তিনি স্বীয় প্রতিজ্ঞা ও আদর্শের বিকাশ সাধনে এমন কোন দিক নেই যেদিকে তিনি অবগাহন করেননি। তাঁর জীবনযাত্রার ধারা ছিল অত্যন্ত পবিত্র ও পুণ্যময় অধ্যায় স্বরূপ। পৃথিবীর প্রতি আসক্তি, লোভ-লালসা, আগ্রহ তাঁর মনে ধারণ করতে পারেনি। আল্লাহর প্রতি একান্ত নির্ভরশীলতা তার হৃদয়ে সদা জাগ্রত থাকতো। তিনি ছিলেন দয়ালু, উদার এবং অসাধারণ গুণের অধিকারী অত্যন্ত বিনয়ী। কোমল ও কঠোর এ দু’য়ের সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর জীবনে। সাদাসিধে জীবন যাপনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। ধৈর্য, সংযম, øেহমমতা ও গাম্ভীর্যের মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। তাঁর চারিত্রিক মাধুর্যের অন্যতম দিক ছিল ভদ্রতা ও সদাচার। গরীব দুঃখী, অসহায়দের তিনি সদা সাহায্য করতেন। তাঁর জীবনযাত্রার ধারা ছিল অত্যন্ত পবিত্র ও পুণ্যময়।

হযরত আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সারা জীবনই কর্মময় ছিল। কর্মময় জীবনের প্রভুত ব্যস্ততার মাঝে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত পালনের নিমিত্তে একান্ন বছর বয়সে তিনি সংসার জীবন শুরু করেন। তিনি একে একে চারজন ভাগ্যবতী মহিলাকে বিবাহ করেন। এই চার মহিলাই পরহেজগার, কামেল, গুণবতী, সেবাপরায়না ও বিশ্বস্ত ছিলেন। তাঁদের গর্ভে ঊনপঞ্চাশজন সন্তান-সন্ততি জন্মগ্রহণ করেন- এর মধ্যে সাতাশজনপুত্র ও বাইশজন কন্যা সন্তান। তাঁদের কেউ কেউ অল্প বয়সে পরলোক গমন করেন। জীবিত সন্তানদের অনেকেই জ্ঞান-গরিমা, বিদ্যা-বুদ্ধি, আধ্যাত্মিক সাধনায় সুনাম অর্জন করেন এবং কয়েকজন এলমে তাসাউফে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশী হওয়া সত্ত্বেও গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হির জীবনযাত্রা পদ্ধতি অতীব সুষ্ঠু ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত হতো। হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর পুত্র ও কন্যাদের বংশধরেরা পৃথিবীর বিভিন্ন মুসিলম দেশসহ অন্যান্য দেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য গমন করেন। তাঁরা সুদীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে মানুষকে হেদায়তের পথে আনায়ন করেন আধ্যাত্মিক সাধনায় উজ্জীবিত করেছেন- যার প্রবহমান ধারা কেয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে।

জাগতিক নিয়মে হযরত আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর জীবনে নেমে এসে বার্ধক্য। তাঁর বর্ণাঢ্য, কৃতিত্বপূর্ণ, গৌরবদীপ্ত বাহ্যিক জীবনেরও ক্রম সমাপ্তি হতে চলল। হিজরি ৫৬১ সনের রবিউল আউয়াল মাসে তিনি অসুস্থতা বোধ করতে থাকেন। অল্প কিছু দিনে আল্লাহর সান্নিধ্যে তাঁকে চির দিনের মতো চলে যেতে হবে তিনি অনুভব করলেন। তাঁর অসুস্থতার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত তাঁর শয্যা পাশে ভিড় জমালো তাঁর একটুখানি পবিত্র সান্নিধ্যের জন্য।

যাঁরা অন্তকালে তাঁর পাশে ছিলেন তাঁদেরকে নসীহত করলেন, তোমরা শুধু আল্লাহকে ভয় করো, তাঁরই ইবাদত করো। তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করো না, কারো কাছে কোনো কিছু প্রত্যাশা করো না। আল্লাহ্ ছাড়া কারো উপর ভরসা করো না এবং একমাত্র তাওহীদ ছাড়া অন্য কিছুর উপর বিশ্বাস করো না।’

জীবন সায়াহ্নের চরম মুহূর্ত আসন্ন। হযরত বড়পীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর চোখে মুখে অদৃশ্য জগতের নূরানী আভা ফুটে উঠল। তিনি পাশে উপবিষ্ট সবাইকে উদ্দেশ করে অতি মৃদুস্বরে বললেন, ‘হে আমার প্রিয়জনেরা! তোমরা আমার পাশ থেকে দূরে সরে বসো, নিকটে আসার জন্য ভিড় করো না। আমি যদিও বা তোমাদের সম্মুখে কিন্তু তোমাদের সাথে আমার বিশাল ব্যবধান বিরাজ করছে। এখানে অদৃশ্য পবিত্র আত্মা ও ফেরেশতারা আগমন করেছেন আমাকে খোশ আমদেদ জ্ঞাপনের জন্যে। তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বসার স্থান খালি করে দাও! পবিত্র আত্মাদের বসার স্থান সংকোচন করো না। এই সময় গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি মুহুর্মুহু উচ্চারণ করতে লাগলেন, ‘ওয়া আলাইকুমুচ্ছালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু, ওয়া গাফারাল্লাহু ওয়া লাকুম ওয়া তা-বা আলাইকুম’। অর্থাৎ আপনাদের উপর আল্লাহর রহমত ও করুণা বর্ষিত হোক, আর আল্লাহ্ আপনাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং আপনাদের তওবা কবুল করুন।’

এরপর তিনি নিজ সন্তানদের অন্তিম বাণী শোনালেন এভাবে: হে আমার সন্তানগণ! তোমরা কখনো ভুলক্রমে গুনাহের পথে পদচারণা করে দোযখের দিকে অগ্রসর হয়ো না। কষ্টার্জিত পুণ্যকে পৃথিবীর মায়া-মোহে জড়িয়ে পরকালে পথেয়শূণ্য হয়ো না। বাইরে-ভিতরে উভয়ভাবে নিবিষ্টচিত্তে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে নিমগ্ন থাকো। শরিয়ত অনুযায়ী চলবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ ছাড়া কাউকে ভয় করো না। পার্থিব জীবনের অভাব-অনটন, আশা-আকাঙ্খা, বিপদ-আপদ, আরাম-আয়েশ, দুঃখ-বেদনা সব অবস্থায় আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ো। যে কোন মুহূর্তে, যে কোন অবস্থায় আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করো না। তাঁর অংশীদার কেউ হতে পারে না। তাওহীদের শিক্ষা প্রচার করার জন্য আবহমান কালধরে নবী-রাসূল এবং তাঁদের উত্তরসূরিগণ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। তোমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করো এবং নামাযের হেফাজত করো। আরো জেনে রেখো, আল্লাহ্ পাকের দরবারে কেউ যদি আমার উছিলা দিয়ে প্রার্থনা করে অবশ্যই তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে। আসন্ন বিপদ আশংকায় মুহ্যমান, অশ্র“সিক্ত বিষন্ন চেহারায় দুঃখ ভারাক্রান্ত তাঁর অন্তিম অমূল্য নসীহত শ্রবণ করে সবাই কৃতার্থ হলেন এবং স্মৃতিপটে চির জাগরুক করে রাখলেন।

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাধক, রূহানী জগতের উজ্জ্বল তারকা, গাউসে সমদানী, কতুবে রব্বানী, মাহবূবে ছোবহানী হযরত শেখ মহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর জীবন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসল। মুসলিম জাতির ভাগ্যাকাশে কালো শোকের চিহ্ন ক্রমে উদ্ভাসিত হলো, প্রকৃতির মাঝে থমথমে ভাব ধারণ করল। ধুলোর ধরণী বিষন্ন মলিন বসন পরিধান করে শোকাকুল হয়ে উঠল।

সম্পর্কিত পোস্ট

আইন-বিধি মেনে কাজের গতি বাড়ানোর তাগিদ

banglarmukh official

মাগুরায় ধর্ষণের শিকার সেই শিশু মারা গেছে

banglarmukh official

জাতিসংঘ মহাসচিব ঢাকায়

banglarmukh official

বরিশালে দুর্ঘটনায় নিহত ২

banglarmukh official

পাকিস্তানে ট্রেনে জিম্মি দেড় শতাধিক যাত্রী উদ্ধার, ২৭ সন্ত্রাসী নিহত

banglarmukh official

পাকিস্তানে যাত্রীবাহী ট্রেন হাইজ্যাক, জিম্মি শতাধিক

banglarmukh official