এপ্রিল ২৬, ২০২৫
Bangla Online News Banglarmukh24.com
অপরাধ জেলার সংবাদ নারী ও শিশু

মিন্নি থেকে রেনু কিসের আলামত?

অনলাইন ডেস্ক :

ইরানের সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ‘স্টোনিং অব সুরাইয়া’ ছবির একটি দৃশ্য। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সুরাইয়াকে পাথর ছুড়ে মারা হচ্ছে। অন্তিম মুহূর্তে রক্তাক্ত সুরাইয়া ঘাতকদের দিকে তাকায়। বাতাসে সুরাইয়ার এলোমেলো কালো চুল খানিকটা মুখের সামনে চলে আসে। ঠিক একই রকম একটি ছবি দেখলাম রোববার গণমাধ্যমে। গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেনু তাকিয়ে আছেন ঘাতক জনতার দিকে। এলোমেলো চুল তাসলিমার মুখ ঢেকে দিয়েছে সুরাইয়ার মতোই। আহ কী নির্মম, কী নিষ্ঠুর, কী ভয়াবহ!

তাসলিমা গিয়েছিলেন সন্তানকে স্কুলে ভর্তির করার তথ্য সংগ্রহ করতে। যিনি নিজেও কিছুদিন স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। কী ভয়ংকর দৃশ্য। তাসলিমাকে পেটাতে পেটাতে মানুষ চিৎকার করছে। এ রকম দৃশ্য আমরা পাই রোমান সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে, যেখানে পরাজিত সৈন্য বা দাসদের নির্মম নির্যাতন-অত্যাচার করে হত্যা করা হতো। ধৃত বীর স্পার্টাকাসের সহযোগীকে টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল জুলিয়াস সিজারের অনুগত সৈন্যরা। আর উল্লাস করতেন রোমের অভিজাত নগরবাসী।

গত কয়েক দিনে কমপক্ষে ১৯ জন মানুষ গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সংখ্যা কমবেশি হতে পারে। তবে শনিবারই পাঁচজন নিহত হয়েছেন গণপিটুনিতে। বিভাজিত সমাজের চরম পরিণতি হচ্ছে এই গণপিটুনি। এখানে সবাই সবাইকে সন্দেহ করে। বিশ্বাস এই সমাজে অনুপস্থিত। এখন আর আমাদের সামষ্টিক বলে কিছু নেই। হয় তুমি আমার পক্ষে, নয়তো বিপরীতে। যুক্তরাষ্ট্রের নয়া রক্ষণশীলেরা এই ধারণার বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। এর প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর হাত ধরে এখন স্থানীয় পর্যায়েও প্রতিফলিত হচ্ছে। খুব সহজেই অন্যকে বিপরীত পক্ষে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ‘মব জাস্টিস’। পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করা হচ্ছে। রাজনীতিতে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করে সুবিধা নেওয়ার প্রবণতাই মব জাস্টিসের বিস্তার ঘটায়। রাষ্ট্রের সর্বত্র যখন শত্রু পক্ষ চিহ্নিত হয়, তখন সাধারণ নাগরিকেরা বসে থাকবে কেন। সমাজ অপরাধী চিহ্নিত করা শুরু করে। রাষ্ট্রের প্রতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি নাগরিকের অনাস্থা যখন চরমে ওঠে, তখনই মব জাস্টিসের চর্চা হয়। কারণ নাগরিক তার রাষ্ট্রকেও বিশ্বাস করে না। শঙ্কায় থাকে রাষ্ট্রের কাছে সুবিচার পাওয়া যাবে না।

আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিই দেখুন। তাঁর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা ওরফে মিন্নি এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পারেন, আবার না-ও থাকতে পারেন। যথাযথ অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। এবং আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আয়শা ঘটনার শিকারও হতে পারেন। দুইভাবেই তিনি ঘটনার শিকার হতে পারেন। খুনের সঙ্গে জড়িত না থেকে, আবার সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেও। কীভাবে? কারণ হচ্ছে আমাদের রাজনীতির সন্ত্রাসায়ন। আগে বলা হতো রাজনীতি নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে। এখন রাজনীতিতে নষ্টরাও সুবিধা করতে পারছে না। পুরোটাই সন্ত্রাসী-গডফাদারদের দখলে। আগে রাজনীতিতে হাতে গোনা কয়েকজন গডফাদারের নাম শোনা যেত। হাল আমলে কম-বেশি সবাই নিজ নিজ রাজ্যে গডফাদার। মাদক ব্যবসা, জবরদখল, টেন্ডারবাজিতে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে, সেই প্রতিযোগিতা চলছে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে।

রিফাত শরীফের হত্যাকাণ্ডকে নেহাতই কোনো প্রেমঘটিত জটিলতা হিসেবে বিবেচনা করা কঠিন। ঘটনা হয়তো এতটা সরল না যে প্রেমের জাদুতে রিফাত শরীফ আয়শাকে ছিনিয়ে নিয়েছেন আর সেই অপ্রাপ্তি থেকে নয়ন বন্ড সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে খুন করেছেন। ঘটনা বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যায়, এই খুনের সঙ্গে মাদক, স্থানীয় রাজনীতি ও প্রভাব বিস্তারের সম্পর্ক থাকতে পারে। নয়ন বন্ড ও রিফাত শরীফ বন্ধু ছিলেন। তাঁদের গডফাদারও ছিলেন নিশ্চয়ই একই জন। রিফাত জেলও খেটেছেন। মাদকসংক্রান্ত এসব ঘটনার মধ্যেই দুজনের মাঝে ঢুকে পড়েন আয়শা। রিফাত ও নয়ন বন্ড গত হয়েছেন। ১ নম্বর সাক্ষী হয়েও আয়শা খুনের দায়ে বিচারের সম্মুখীন। অন্য চার আসামি পলাতক। অভিযোগ রয়েছে, তাঁরা ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট।

তবে আয়শার বাবা অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় সাংসদের ছেলেকে বাঁচাতেই আয়শার কাছ থেকে জবরদস্তি করে স্বীকারোক্তি আদায় করেছে পুলিশ। এরও আগে আদালতে কোনো আইনজীবী যেন আয়শার পক্ষে না লড়েন, এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন সাংসদপুত্র সুনাম দেবনাথ—এই অভিযোগও করেছেন আয়শার বাবা। সত্যিই রিমান্ডের আগ পর্যন্ত আয়শার কোনো আইনজীবী ছিলেন না। কেউ রাজি হননি। রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার আয়শাকে আদালতে তোলার কথা ছিল। ঢাকা থেকে ৪০ জন আইনজীবী আয়শার পক্ষে আদালতে দাঁড়ানোর ঘোষণার পরপরই আয়শাকে অনেকটা চুপিসারে আদালতে তুলে স্বীকারোক্তি রেকর্ড করা হয়। এমনকি আদালত থেকে নেওয়ার পথে আয়শা গণমাধ্যমের কর্মীদের কিছু বলতে চাইলেও মহিলা পুলিশ তাঁর মুখ চেপে ধরে। আয়শা পরে জেলগেটে তাঁর বাবাকে জানিয়েছেন, পুলিশের শিখিয়ে দেওয়া কথাই তিনি আদালতে বলেছেন।

আয়শাকে নিয়ে লুকোচুরি কেন? বা মুখই চেপে ধরা হলো কেন? তিনি কি এমন কিছু বলে দিতেন, যা অন্যদের জন্য বিব্রতকর হতো বা আয়শার বাবাই বা কেন বারবার সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বা সুনাম শম্ভুর কথা বলছেন। এই ঘটনার সঙ্গে শম্ভুর ছেলে কীভাবে জড়িত, তা আমাদের জানা নেই। বিভিন্ন জনের কথা শুনে ও বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে শুধু কিছু পূর্ব ধারণা তৈরি করা যায়। অনেকেই সন্দেহ করছেন আয়শাকে সামনে এনে নেপথ্যের নায়ককে আড়াল করা হতে পারে।

রাজনীতির সন্ত্রাসায়ন, আগের রাতেই ভোটের বাক্স ভরে ফেলা সমাজকে প্রভাবিত করবে নিশ্চিত। এতে করে রাষ্ট্রের প্রতি ভয় ও অনাস্থা দুটোই বাড়বে। এই পরিস্থিতিতেই তাসলিমারা গণপিটুনির শিকার হবেন। আয়শা ১ নম্বর সাক্ষী হয়েও আদালতে খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দেবেন । নুসরাত, তনু হারিয়ে যাবেন অকালে। কিন্তু প্রকৃত নায়ক বা নিয়ন্ত্রকেরা আড়ালেই থেকে যাবেন এবং যাচ্ছেন। তাঁরা বরং রাজনীতিতে শক্ত করে গেড়ে বসবেন। কোনো এলাকা থেকে সাংসদ-মন্ত্রী হবেন। এলাকা নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা সবকিছুই রাজনীতির সঙ্গে মিশে একাকার। অর্থ ও সম্পদের ধারাবাহিকতায় ভোগদখলের বিষয়ও চলে আসে। এখানেই ঘটে নারীর উপস্থিতি। এ জন্যই আয়শা, নুসরাত বা তনুরা শিকারে পরিণত হন। অবধারিতভাবে নারী হচ্ছেন দুর্বৃত্ত, ক্ষমতা ও ভোগবিকারের বলি। কান ধরে ওঠবস করতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষক থেকে প্রেমিক সবাই। সবই রাজনৈতিক নেতার নির্দেশে। সন্ত্রাস ও গডফাদার-নির্ভর রাজনীতি এখন গোটা জাতিকেই কান ধরে ওঠবস করাচ্ছে, পিটুনি দিয়ে মেরে ফেলছে। এসব কারণেই গুজবের নানা ডালপালা সৃষ্টি হয়। মবজাস্টিস বেড়ে যায়। সব মিলে ভয়ংকর এক সমাজে তাসলিমার শিশুকন্যাটি বেড়ে উঠবে।

একদিন জানবে শহরবাসী তার মাকে খুন করেছিল। সেই নগরীতেই সে বড় হয়ে উঠবে।

সম্পর্কিত পোস্ট

মাগুরায় ধর্ষণের শিকার সেই শিশু মারা গেছে

banglarmukh official

শিশু আছিয়ার জানাজায় অংশ নিতে মাগুরায় মামুনুল-হাসনাত-সারজিস

banglarmukh official

অটোরিকশায় ছাত্রীর সঙ্গে অশোভন আচরণ, ভিডিও ভাইরাল

banglarmukh official

বগুড়ায় স্কুলছাত্রকে শ্বাসরোধ করে হত্যা

banglarmukh official

মাগুরায় শিশু ধর্ষণ: ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার নির্দেশ হাইকোর্টের

banglarmukh official

বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার শিশু, ভগ্নিপতি ও শ্বশুর আটক

banglarmukh official