সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর খোকনের মৃত্যুর খবরটি যখন পাই তখন রাত সোয়া ১০টা। সবে রাতের খাওয়া শুরু করেছি। প্রিয় সংবাদকর্মীর আচমকা এই মৃত্যুর খবরের পর গলা দিয়ে খাবার আর নামেনা। উঠে পড়লাম ডাইনিং টেবিল থেকে। নিজের অজান্তেই কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম। জীবন কত তুচ্ছ! নিমিষেই ঝরে গেলো একটি তাজা প্রাণ-একজন প্রাণবন্ত, পরিশ্রমী সংবাদকর্মী এভাবে চলে যাবেন! ভাবতে থাকি। রাতের ঘুম আর হয় না। সেহরি খেয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবি আচ্ছা সাংবাদিকের প্রাণ কি আরও তুচ্ছ? সাংবাদিক মরলে কার কী! এই ভাবনাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়।
মোটামুটি আমরা সবাই নিশ্চিত যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর খোকনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর কয়েক মিনিট পর থেকেই আমরা সাংবাদিক সমাজ শোক জানাচ্ছি। ফেসবুক জুড়ে মৃত সাংবাদিকের ছবি আর আবেগঘন কথাবার্তা। শোক জানাচ্ছেন রাজনীতিক, মন্ত্রী, সাংসদ, আমলাসহ আরো অনেকে। যারা ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনতেন, জানতেন। কয়েকদিন এরকমই চলবে। হয়তো প্রেসক্লাব, বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর অফিস ঘিরে কালো কাপড়ের শোক ব্যানার টাঙানো হবে। একইরকম ব্যানার হয়তো থাকবে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি আর তার শেষ কর্মস্থলসহ আগের দু’একটি কর্মস্থলেও। ব্যস! ওই পর্যন্তই। এরপর থেমে যাবে আলোচনা, শোক শেষ হবে। পরিবার মুখোমুখি হবে এক কঠিন বাস্তবতার।
কিভাবে চলবে সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর খোকনের সংসার? কল্যাণ গড়ে ওঠা একাধিক সংগঠন? আমরা কিচ্ছু জানিনা। এত অনিশ্চয়তা, এত দ্রুত প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া আর কোনো পেশায় আছে কি? শুধুমাত্র সাংবাদিকতা পেশা ছাড়া?
সংকটে দায়িত্বপালনকালে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রশাসন-পুলিশ ও প্রজাতন্ত্রের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রয়োজনমতো ঝুঁকি ভাতা পাবেন। আর কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে কোনো দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর মৃত্যু হলে তার পরিবার পদমর্যাদা অনুসারে এককালীন বিশেষ অর্থ সহায়তা পাবেন। থাকবে বীমার ব্যবস্থা। এরকম একগুচ্ছ সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য। এই প্রণোদনা, উৎসাহমূলক আয়োজন এর ঘোষণা এসেছে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। খুবই সাধুবাদযোগ্য এই পদক্ষেপ। এতে অনেকের মধ্যে দায়িত্বপালনের ভীতি কাটবে। ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতাও বাড়বে। যদিও কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে দেশের একজন নাগরিকেরও মৃত্যু না হোক এটাই আমাদের চাওয়া। তবু উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি যখন হঠাৎই চলে যান তখন যে কঠিন অনিশ্চয়তায় পড়ে গোটা পরিবার তা সামলানোর চিন্তাও তো এসে পড়ে। বিশেষত অকাল প্রয়াত ব্যক্তিটি যদি রাষ্ট্রের বা সমাজের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন শেষ পর্যন্ত তাহলে রাষ্ট্র বা সমাজ কোনো দায় নেবে না? আমরা প্রীত যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তবু কিছুটা রাষ্ট্রের আনুকূল্য পাচ্ছেন কোনো না কোনোভাবে।
কিন্তু সাংবাদিক? কিংবা গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের কি কোন ধরনের নিরাপত্তা আছে? পেশাগত নিরাপত্তা একেবারেই নেই সাংবাদিক-কর্মচারীর। নেই আর্থিক, সামাজিক, নিরাপত্তা। আর এতো নেই নেই এর মাঝে এই সংবাদকর্মীরাই তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। একদিকে মানুষের কাছে দেশের বিদেশের সর্বশেষ রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, বিনোদনসহ সব খবর পৌঁছে দিচ্ছেন। অন্যদিকে সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করছেন। প্রয়োজনে সবার লাগে এই গণমাধ্যম আর গণমাধ্যমকর্মী। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে গণমাধ্যম কর্মীদের ছিদ্র অন্বেষণই দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিতদের একমাত্র কাজ। এমনই মনে হয় আজকাল।
যত দিন যাচ্ছে গণমাধ্যমকর্মীরা অবহেলার পাত্র হয়ে উঠছেন, এটি স্পষ্ট। ‘মিডিয়া’ বা গণমাধ্যমকে যতই ‘ফোর্থ এস্টেট’ বলা হোক না কেন বাস্তবে আমরা যা পাচ্ছি তা হলো গণমাধ্যম কর্মী মানেই এক ধরনের তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের পাত্র ক্ষেত্র বিশেষ। গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য যে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই এটা তো বহুকাল ধরেই প্রতিষ্ঠিত। ক্ষেত্র বিশেষ যে নাগরিক অধিকার পাওয়ার কথা একজন সংবাদকর্মীর, তাও উপেক্ষিত। কটা উদাহরণ দেব?
কুড়িগ্রামে জেলা প্রশাসনের হাতে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় প্রহৃত সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের ঘটনার প্রকৃত বিচার কি হয়েছে? হয়নি। জেলা প্রশাসক ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন মর্মে তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে মাত্র। কি ফৌজদারী অপরাধ করে পার পেয়ে গেছেন প্রশাসনের ওই কর্মকর্তা ও (উপসচিব, সুলতানা পারভীন) তার সহযোগী অন্য কর্মকর্তারা। মিডিয়ায় বহুল প্রচারের কারণে হয়তো ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা হয়েছিল সাংবাদিক নিগ্রহের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা উপযুক্ত শাস্তি পাবেন। কিন্তু তাদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা ছাড়া আদৌ আর কিছু হয়নি। হবেও না, কারণ এটি কার্যত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, সাংবাদিক নিগ্রহ করলে কিছু হয় না। যেখানে সাংবাদিক খুন হলে একটা চার্জশিট পর্যন্ত হয় না সেখানে সাংবাদিক নিগ্রহের বিচার চাওয়াও তো বোকামি!
সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি কি খুব হননি? বছরের পর বছর পার হয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এলিট ফোর্স হিসেবে স্বীকৃত র্যা ব এর কুলকিনারা করতে পারেনা। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? যে র্যা ব দেশ থেকে জঙ্গিবাদের শিকড় উৎপাটনে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে সেই র্যা ব একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের তদন্তে দিশা খুঁজে পাবেনা, এটি মানা যায়না। হয়তো খুন হয়ে যাওয়া দুজন সাংবাদিক বলেই গাছাড়া ভাব। সাগর-রুনি হত্যার প্রতিবেদন দাখিলের সময় পিছিয়েছে ৭২ বার। এটা কি মেনে নেওয়া যায়?
সাংবাদিকরা যে সরকারি দায়িত্বশীলদের কতটা প্রকৃত গুরুত্ব আর মনোযোগ পান তার উদাহরণ দিতে গেলে ২০ বছর আগে খুন হয়ে যাওয়া যশোরের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শামসুর রহমানের নাম আসবেই। আলোচিত এই সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি। যশোরের আরেক প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিক রানার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল হত্যা মামলা ঝুলে আছে ২২ বছর ধরে। ১৯৯৮ সালের ৩০ আগস্ট রাতে কর্মস্থল থেকে বেজপাড়ার নিজ বাসভবনে ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের বোমার আঘাতে খুন হয়েছিলেন সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল। একুশে পদক পাওয়া দৈনিক সংবাদের খুলনা প্রতিনিধি মানিক সাহা