ফণী আর বুলবুলের ক্ষত উস্কে দিয়ে একই পথে এগোচ্ছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। এখনো উপকূলের আকাশ পরিষ্কার দেখালেও ফুঁসছে সমুদ্র। মাছধরার নৌকাগুলো তীরে ফিরেছে। ঝড়ের গতিপথ এবং ভয়াবহতার খবর মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তবে এখনো অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয় ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা।
গতি কতটা শক্তিশালী হবে, তা এখনো পর্যন্ত বোঝা না গেলেও চোখ রাঙিয়ে ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে আসছে উপকূলের দিকে। বাংলাদেশ অথবা ভারত, আঘাত যেখানেই লাগুক না কেন, এবারও সুন্দরবনেই লাগতে পারে ঝাপটা। এবারও ভয়ে সুন্দরবন। আতঙ্ক রয়েছে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষের মনে। নাজুক বেড়িবাঁধ তাদের সেই ভয় আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ঘূর্ণিঝড় কোথায়, কতটা শক্তি নিয়ে আঘাত করবে, এখনো তা বলার সময় আসেনি, বলেছ দেশি-বিদেশি আবহাওয়া দফতরের সূত্রগুলো। তবে এখন পর্যন্ত গতি প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে মঙ্গল অথবা বুধবার এটি উপকূলের আছড়ে পড়তে পারে। মাত্র এক দশক আগে প্রবল শক্তি নিয়ে উপকূলে আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় আইলার সর্বোচ্চ গতি ছিল ১১২ কিলোমিটার। আম্ফানের গতি ১৭০-১৮০ কিলোমিটারে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে সামনের সময়ে গতি কতটা পরিবর্তন হবে, তা বলা যাচ্ছে না। দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রতলের তাপমাত্রা ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে অনুকূল, তাই গতি ক্রমে বাড়ছে। সেখানকার তাপমাত্রা এখন ৩০-৩১ সেলসিয়াস। কিন্তু নিকটবর্তী উপকূলে সমুদ্রতলের তাপমাত্রা অনেক কম। ফলে কাছে এসে এর গতি কমে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। স্থলভাগের শুকনো হাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের গতি আরও কমিয়ে দিবে। এমনটাই আশাবাদ আবহাওয়াবিদদের।
ঘূর্ণিঝড় ফণী আর বুলবুল আঘাত করেছিল সুন্দরবনে। এগারো বছর আগে ২০০৯ সালে আইলাও আঘাত করেছিল সুন্দরবনে। এবারের গতিও বলছে, ঝুঁকিতে রয়েছে সুন্দরবন। ঠিক এক বছর আগে ২০১৯ সালের ৩মে’র ঘূর্ণিঝড় ফণী এবং ছ’মাস আগে ৯ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি করতে না পারলেও ক্ষতির পরিমাণ একেবারে কম ছিল না। তবে আইলায় ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। সুন্দরবনের আশপাশের জনজীবন ওলটপালট করে দিয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় আইলা। সেই ক্ষত ওই এলাকার মানুষ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। দশ বছরেও সে অঞ্চলের মানুষ ক্ষতি কাটিয়ে তো উঠতে পারেনি; বরং ঝুঁকি আরও বেড়েছে। আইলা-শক্তির ঘূর্ণিঝড় সামাল দেওয়ার শক্তি নেই সুন্দরবনের আশপাশের বহু এলাকার।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের সতর্কতায় উপকূল জুড়ে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রস্তুতিমূলক বৈঠক করেছে। কিন্তু মাঠের অবস্থা কী? জানতে চেয়েছিলাম সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডলের কাছে। তিনি জানালেন, ঘূর্ণিঝড় আসার খবরেই আমরা নড়েচড়ে বসি। আসার আগে তড়িঘড়ি করে সব কাজ করার করার চেষ্টা করি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় চলে গেলে আর কিছু মনে থাকে না। উপর মহল আমাদের কাছে জরুরি আদেশ পাঠিয়েই খালাস। বাজেট বরাদ্দ আসবে কিনা খবর থাকে না। অথচ কাজগুলো আমাদের করে যেতে হয়। গত বছর ঘূর্ণিঝড় ফণীর পরে যেসব আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল; যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল; তার খুব একটা বাস্তবায়ন দেখছি না। যা হয়েছে বলা যায় জোড়াতালি।
সুন্দরবন লাগোয়া সাকবাড়িয়া নদীর তীরের নাজুক বাঁধ, কয়রা/ ছবি: র ই মন্টু
ঘূর্ণিঝড় আসার খবর এলেই নজর পড়ে উপকূলের প্রস্তুতির দিকে। পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূলের অনেক স্থানেই নড়বড়ে অবস্থা রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে। পশ্চিম উপকূলের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি, দেবহাটার অনেক স্থানের নাজুক অবস্থা রয়েছে। শ্যামনগরের ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে গাবুরা, পদ্মপুকুর ও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন ঝুঁকিতে রয়েছে। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চুনা নদী তীরবর্তী কলবাড়ি নামক স্থান ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া দাতিনাখালী আতিয়ার মোড়লের বাড়ির সামনে, দুর্গাভাটি নেছার মালির বাড়ি সামনে, হাকিম গাজীর বাড়ির সামনে, নীলকান্ত মেম্বারের বাড়ির পাশে, সব নিয়ে ইউনিয়নে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ।
দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার চারিদিকে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১০ কিলোমিটার চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানালেন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম। তিনি বলেন, চার নম্বর সতর্কতা সংকেত ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এখনো আকাশে ঝকঝকে, কোথাও এক টুকরো মেঘ নেই। এখন তো মানুষজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলতে পারছি না। তবে উপরের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। মি. আলম জানান, ঘূর্ণিঝড়ের আভাস এলে এই ইউনিয়নের ৪৫ হাজার মানুষ আতংকে থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের পরে আশ্বাস পেলেও তা পূরণ হয় না। ঘূর্ণিঝড় ফণী পর দু’ দু’বার মন্ত্রী এলেন, সচিব এলেন, পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন কাজ হয়নি। এগারো বছর আগের ঘূর্ণিঝড় আইলা গোটা গাবুরা ভাসিয়েছিল লবণ পানিতে। এখনো বিপন্নতা কাটেনি।
ওদিকে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার খোলপেটুয়া নদীর জোয়ারের চাপে বছরে বেশ কয়েকবার ভেঙে যায় বাঁধ। ভাসে গ্রামের পর গ্রাম। অনেক মানুষ এলাকা থেকে অন্যত্র চলে গেছে। বাঁধ সংস্কার কিংবা নতুন বাঁধ নির্মাণে কোন উদ্যোগ নেই। ২০০৯ সালের আইলা সে এলাকার বাঁধও নড়বড়ে করে দিয়েছিল। ফণীর পরে আশ্বাস পাওয়া গিয়েছিল বাঁধ হবে। কিন্তু হয়নি। ফলে এবারের বর্ষা মৌসুমেও ঝুঁকিতেই রয়ে গেল আশাশুনির ওই এলাকা।
কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে খুলনার কয়রা উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থান ঝুঁকিতে রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দা আকতারুল আলম সৌরভ জানালেন, উপজেলার দশালিয়া, উত্তর মদিনাবাদ, গোবরা, ঘাটাখালী, হরিণখোলা, কাঠকাটা, বেতবুনিয়া, ঘড়িলাল, গোলাখালী, আংটিহারা, চরামুখা এলাকার বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই নাজুক। বেশ কয়েকদিন আগে পূর্ণিমার জোয়ারে বেড়িবাঁধ ধ্বসে লোকালয় ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলে স্থানীয় বাসিন্দারা স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামত করে। বর্ষাকালে এই এলাকার মানুষ চরম ঝুঁকিতে থাকে। বাঁধ মেরামতের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আশ্বাস পাওয়া গেলেও কোন কাজ হয়নি। এভাবে পড়ে আছে বছরের পর বছর।
কয়রা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবন লাগোয়া দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন। এখানকার বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই নাজুক। বর্ষায় ঝুঁকি বাড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল না হলে জোয়ারের পানিতেই পানি উঠে যায় বাঁধ ছুঁই ছুঁই। গেল বছর মে মাসের প্রথমে ঘূর্ণিঝড় ফণী আর নভেম্বরে বুলবুলের আঘাতে এলাকার মানুষজন চরম আতংকে ছিল। বুলবুলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। মাছের ঘেরে ঢুকে পড়েছিল নোনা পানি। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কবি শামসুর রহমান বলছিলেন, ইউনিয়নের সাড়ে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ কিলোমিটার অত্যন্ত নাজুক। এরমধ্যে আবার সাত কিলোমিটার মোটর বাইক চলাচলের অনুপযোগী। বেড়িবাঁধ এভাবে নাজুক অবস্থায় রেখে দুর্যোগের ঝুঁকি কীভাবে সম্ভব? প্রশ্ন রাখেন তিনি। মি: রহমান বলেন, সরকারি সাহায্য যা আসে, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। কাকে রেখে কাকে দেই। এ এলাকায় নাজুক বেড়িবাঁধই এ এলাকার প্রধান সমস্যা। শক্ত করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে উঁচু বেড়িবাঁধ হলেও ঝুঁকি কমেনি খুলনার দাকোপ, কিংবা বাগেরহাটের শরণখোলায়। দাকোপের সুন্দরবন লাগোয়া সুতারখালী ইউনিয়নের বেশকিছু এলাকা বরাবরই ঝুঁকিতে থাকে। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর উঠে দাঁড়াতে পারেনি কালাবগি গ্রামটি। এলাকাটি অনেক আগেই ঝুলন্ত গ্রামে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নির্মিত বেড়িবাঁধের বাইরে রয়েছে এলাকাটি। শরণখোলায় ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত করেছিল ২০০৭ সালে। যেখানে আঘাত করেছিল সেই গাবতলা, বগীর অবস্থা এখনো নাজুক। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নতুন বেড়িবাঁধ নির্মিত হলেও তা বার বার ধ্বসে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে যায়।
কেন একই পথে বার বার ঘূর্ণিঝড়ের ছোবল? প্রশ্নের জবাবে দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। তবে এক এক দশকে এক এক ধরণের ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। এক সময় দেখেছি, ঘূর্ণিঝড়গুলো মায়ানমারের ওপর দিয়ে যায়। আবার দেখলাম বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালীর ওপর দিয়ে যায়। কয়েক বছর ধরে দেখছি, উড়িষ্যা-বাংলাদেশ অভিমুখে আসছে। তিনি বলেন, আম্ফান কতটা শক্তি নিয়ে উপক‚লে আঘাত করবে; সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। ফণী বা বুলবুলের গতিতে আসলে সুন্দরবন তো কিছুটা ঝুঁকিতে থাকবে। প্রস্তুতির ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে অনেক সমস্যা আছে। সেগুলোর দিকে নজর দিতে হবে।
করোনা আতংকের মাঝে বাড়তি এক আতঙ্ক নিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা করোনা জয়ের কৌশল; কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার সঙ্গে সম্পৃক্ততা মানুষের একত্রিত হওয়ার। আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের একত্রিত হতে হবে। প্রস্তুতি ও ত্রাণ কার্যক্রমেও মানুষের একত্রিত হওয়ার কোন বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে আম্ফান কতটা ভোগান্তিতে ফেলে, সেটাই দেখার বিষয়।