চলতি বছরে ছয়বার ভূমিকম্প হলো সিলেটে। শুক্রবার দিবাগত রাত ৩ টা ৪ মিনিটে আরো একবার কেঁপে উঠলো সিলেট। এনিয়ে চলতিমাসে তিনবার এবং চলতি বছরে ৬ষ্ঠবারের মতো এই ভূমিকম্প হলো। সিলেটে গড়ে প্রতিমাসে একবার এই ভূকম্পনকে সিলেটের জন্য অশনী সংকেত বলে ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। এর আগে সিলেট অঞ্চলে নিয়ম করে প্রতি মাসে ভূ-কম্পন হয়নি- এমনটিও বলেছেন তারা।
এমনিতেই সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। আর ডেঞ্জার জোনে সিলেটের অবস্থান। চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি বছরের প্রথম ভূমিকম্প হয় সিলেটে। ওইদিন বেলা ১টা ১২ মিনিটে এই ভূ-কম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে হয় ৪.১। ১৪ এপ্রিল ২য় বারের মতো এই কম্পন সৃষ্টি হয় রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল হয় ৩.৬।
ঠিক পরের মাসের তৃতীয় ভূকম্পন হয় ২৫ মে রাত ৮টা ৪২ মিনিটে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫.১। চলতি মাসে চতুর্থ বারের মতো ভূকম্পন হয় ২১ জুন। ওই দিন বিকেল ৪টা ৪৮ মিনিটে এই কম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.১। ২২ জুন ভোররাতে ৫ম বারের মতো ভূমিকম্প হয় সিলেটে। ওইদিন ভোর ৪টা ২২ মিনিটে হয় ৫.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।
শুক্রবার (২৬ জুন ) ভোর রাতে চলতি মাসে তৃতীয়বারের মতো ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে সিলেট। আবহাওয়া অধিদপ্তর ঢাকা সূত্রে জানা গেছে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৪। এর উৎপত্তিস্থল ছিল চীনের হুতান শহরে।
গভীর রাতে ভূমিকম্প অনুভূত হলে অনেকের ঘুম ভেঙ্গে যায়। এসময় তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। অনেকে বাসা বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। ভূমিকম্প যখন হচ্ছিল তখন বাইরে বৃষ্টি চলছিল। তবে ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত কোথাও কোন ক্ষয়-ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
এর আগে এক সপ্তাহেই সিলেটে দুই দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মধ্যে গত রবিবার (২১ জুন) বিকেল ৪টা ৪৯ মিনিটের দিকে প্রথমবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ১। এর প্রায় ১২ ঘন্টা ব্যবধানে সোমবার (২২ জুন) ভোর ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে দ্বিতীয় দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যার মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৮।
এ ভূমিকম্পটির স্থায়িত্ব ছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ড। এটিরও উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত মিয়ানমার সীমান্ত। আইজল অঞ্চলের ওই ভূমিকম্পের গভীরতা ছিল ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩৫ কিলোমিটার। আসাম, মেঘালয়, মণিপুরেও তার প্রভাব পড়ে। ফলে সিলেট ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয় ।
ভূবিজ্ঞানীদের মতে ছোটো ছোটো ভূমিকম্প বড়ো মাত্রার ভূমিকম্পের লক্ষণ। সিলেটে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় ১৩০৪ বাংলা সনের ৩০ জ্যৈষ্ঠ। দিনটি ছিল শনিবার। অর্থাৎ, আজ থেকে ১২৩ বছর পূর্বে। ওই ভূমিকম্পে তৎকালীন সিলেট শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সিলেট অঞ্চলের প্রবীণেরা এটাকে বলেন–বড়ো ভইছাল। তাই সিলেটে ঘন ঘন ভূকম্পন খুব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার।
সিলেটের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমেদ জানান, এ অঞ্চলে সাধারণত ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত ও মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে ভূকম্পন হয়ে থাকে। সর্বশেষ দুটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিলো মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা। যার ফলে ভারতের মিজোরাম, গোয়াহাটি, হাইলাকান্দি, বাংলাদেশের কক্সবাজার ও সিলেটের আশেপাশের এলাকায় মৃদু কম্পন অনুভূত হয়।
ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের দুই দিকের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। এর একটা হচ্ছে উত্তরপূর্ব কোণে সিলেট অঞ্চলের ডাউকি ফল্ট, আরেকটা হচ্ছে পূর্বে চিটাগাং ত্রিপুরা বেল্টের পাহাড়ি অঞ্চল। এখানে দুটি বড় ধরণের ভূমিকম্প বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ভূমিকম্প গবেষণা কেন্দ্রের এক জরিপ অনুযায়ী, ভূ-স্তরের টেকটোনিক প্লেট ফাটলের কারণে ইউরেশিয়া ও ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের ভূমিকম্পের জোনের মধ্যেই রয়েছে চট্টগ্রাম। এ প্লেট দুটি অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ কারণে ঘন ঘন হালকা থেকে মাঝারি মাত্রায় ভূমিকম্প হচ্ছে।
গবেষকদের মতে, মৃদু হালকা কিংবা মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প অদূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বহন করে। আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমেদ জানান, ১৯১৮ সালের পর সিলেট থেকে কোনো ভূকম্পনের উৎপত্তি হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি ২০২০ সালে আড়াই মাসের মধ্যে পরপর দুইবার সিলেটের ডাউকি ফল্টের পাশের গোয়াইনঘাট এলাকা থেকে দুটি ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে।
এর মধ্যে ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল সোমবার দিনগত রাত যে ভূমিকম্প হয়, এর উৎপত্তিস্থল ছিলো সিলেটের উত্তর পূর্ব গোয়াইনঘাট এলাকায়। এর আগে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারির যে ভূমিকম্প হয় সেই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিলো একই এলাকা। তবে সম্প্রতি এসব ভূমিকম্পে বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
২২ জুনের ভূমিকম্প সিলেটসহ সারাদেশেই অনুভূত হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেডিও মেকানিক ইকবাল আহমদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গণমাধ্যমকে জানান, সোমবারের কম্পনের মাত্রা ছিলো রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৮। উৎপত্তিস্থল ভারত মিয়ানমার সীমান্ত। ঢাকা আগারগাঁওয়ের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থলের দূরত্ব ছিল ৩০১ কিলোমিটার।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র ছিল মিজোরামের চম্পাই এলাকা থেকে ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। এর গভীরতা ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০ কিলোমিটার। এ ভূমিকম্প পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু জায়গায় অনুভূত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে মিয়ানমারেও।